দুর্নীতি আর দুর্নীতির ধারণা যারা এক করছে, তাদের উদ্দেশ্য স্বচ্ছ নয়

দিনকাল বাংলাদেশ

সোহাইল জাফর

 

এবারও দুর্নীতির ধারণা সূচকের প্রতিবেদন প্রকাশ করলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। এবার ২৪ স্কোর পেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ নম্বর। ২০২৩ সালে ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৭ নম্বরে। অর্থাৎ বিশ্বে বাংলাদেশের চেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ মাত্র ১৭০টি। এভাবেই বলা হয় সবসময়। অথচ প্রতিবেদনে লেখা হয় এটা দুর্নীতির ধারণা সূচক। কিন্তু উপস্থাপন করা হয় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে। খুব সুক্ষ্মভাবে ধারণা শব্দ এড়িয়ে যাওয়া হয়। পরিস্কার করে বলা হয় না যে দুর্নীতি ও দুর্নীতির ধারণার বিষয়টি এক নয়। এবারও তাই হয়েছে।

 

এ নিয়ে সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়েছেন কয়েকজন গবেষক। তারা বলছেন এটা অনেকটা, আপনার একটি বাড়ির মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে ব্যাংক, ইন্সুরেন্স কোম্পানি এবং সিটি কর্পোরেশন ভিন্ন ভিন্ন ধারণা তৈরি করার মত। তারা প্রত্যেকেই যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী আপনার বাড়ীর দাম ঠিক করবে এবং কারো সঙ্গে কারণা ধারণা মিলবে না। একটি বাড়ীর ভিন্ন ভিন্ন দাম। এপ্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সবচেয়ে প্রচলিত জোকসটি হলো অনেকটা এরকম। আমার বন্ধুবান্ধবের ধারণা আমার বেতন কোটি কোটি টাকা। আর আমার পরিবারের ধারণা আমাকে অফিস থেকে কোনো বেতনই দেওয়া হয় না। অথচ ব্যক্তি কিন্তু সেই আমি।

 

অর্থাৎ বাস্তবতা আর ধারণা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হতে পারে। একই ভাবে একটি দেশের দুর্নিতী নিয়ে একটি দেশের সম্পর্কে একেক সংগঠনের ধারণা একেক রকম হতে পারে। বাংলাদেশ নিয়ে গত ১৪/১৫ বছর ধরে টিআইবির দুর্নীতির ধারণা সূচক একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে। অথচ এর মধ্যে বাংলাদেশে নীতি এবং কাঠামো উভয় ক্ষেত্রেই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই দুদকের ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। ডিজিটাল কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রবর্তন, অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি প্রসারিত করেছে। শুধু তাই নয়, হুইসেল ব্লোয়ার আইন, তথ্য অধিকার আইন ও কমিশন প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনেক নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই সাথে সারাদেশে ডিজিটাইজেশন করা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দুর্নীতি ও হয়রানি অনেক কমানো হয়েছে।

 

কিন্তু টিআইবি’র রিপোর্ট দেখে মনে হয় গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে কোনো কাজই হয়নি। অথচ এর মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৫৪৩ ডলার থেকে ২৭৯৩ ডলারে বৃদ্ধি পেয়েছে, জিডিপি ৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ৫০ লক্ষ কোটি টাকা হয়েছে। মুড়ির টিনের লক্করঝক্কর জার্নি থেকে দেশ মেট্রোরেলে ব্যবস্থায় রূপান্তর হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুস্বাস্থ্য, দুর্যোগ মোকাবেলা এবং সামাজিক নিরাপত্তায় বাংলাদেশের সাফল্যের স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব সংস্থাগুলো। অথচ টিআইবির প্রতিবেদনে উল্টো চিত্র।

 

বিশ্বজুড়ে টিআইবির মূল সংগঠন টিআই এর সমালোচকরা বলেন, এদের রিপোর্ট সব সময় একটি রাজনৈতিক দল বা বিশেষ কোন গোষ্ঠীর পক্ষে যায়।  অবশ্য এটা প্রমাণের জন্যে বাংলাদেশের চেয়ে বড় উদাহরণ তো আর হয় না। ২০১২ সালে দূার্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট যেখানে ছিল ২.৬, ২০২৪ সালে এসে তা কমে হয়েছে…। বিএনপির চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ২০০৬ সালেও বাংলাদেশের পয়েন্ট এমনই ছিল। অথচ ২০০৬ সালের বাংলাদেশ আর ২০২৪ সালের বাংলাদেশের মধ্যে আকাশপাতাল ব্যবধান। অথচ টিআই এরকমই ধারণা সূচক তৈরি করছে বছরের পর বছর। তাই সারা পৃথিবীর একাডেমিশিয়ান এবং উন্নয়ন গবেষকরা এই ধারণা সূচক নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের মূল অভিযোগ, টিআই কেন, কার কাছ এবং কিভাবে এই ধারণার তথ্য নিচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয় না।

 

বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ অ্যালেক্স কোবহ্যাম বলেন, টিআই-এর রিপোর্টগুলো সুশীল সমাজের কথা বলে দুর্নীতির জনপ্রিয় ও বিভ্রান্তিকর ধারণাগুলো সামনে নিয়ে আসে, যা একটি রাষ্ট্র সম্পর্কে অন্য রাষ্ট্রের কাছে ভুল বার্তা দেয়। আরেক বিশ্ববিখ্যাত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক পল হেইউড বলেন, অনেক বছর ধরেই টিআই রিপোর্ট করছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। পদ্ধতিগতভাবে টিআই-এর গবেষণায় অনেক ভ্রান্তি আছে। এই গবেষনা বরং সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে ‘দুর্নীতির ফাঁদ’ তৈরি করার ঝুঁকি বাড়ায়। এসব কারণেই বিশ্বব্যাপী টিআই-এর ধারণা সূচক একটি অগ্রহণযোগ্য প্রতিবেদনে পরিণত হয়েছে।

গত কয়েক বছরে টিআই নিজেই অনেক দুর্নীতিতে জড়িত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এগুলো কোনো ধারণা নয়। প্রামাণ্য দুর্নীতি। যেমন ২০১৪ সালে সিমেন্স কোম্পানি থেকে ৩ মিলিয়ন ডলার ফান্ড টিআইবি নেয়। যে কোম্পানি ২০০৮ সালে বিশ্বে দুর্নীতির জন্য সর্বোচ্চ ১.৬ বিলিয়ন ডলার জরিমানা দিয়েছে। ২০১৫ সালে টিআইবির ‘ওয়াটার ইন্টেগ্রিটি নেটওয়ার্কের’ আর্থিক লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিষয়টি প্রমাণ হওয়ায় মিজ আনা বাজোনি নামের এক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। দুর্নীতির অভিযোগে টিআই-এর আমেরিকা এবং ক্রোয়েশিয়া চ্যাপ্টার বাতিল করা হয়। সংস্থার ভেতরে দুর্নীতি এবং হুইসেল ব্লোয়ারদের ব্যবহার করার অভিযোগ তুলে সংস্থার এমডি প্যাট্রিসিয়া মোরেইরা ২০২০ সালে পদত্যাগ করেন। তার পূর্বসূরি আরেক এমডি ডি সোয়ার্ত ২০২১ সালে এই একই অভিযোগ নিয়ে একটা বই লিখেছেন।

 

২০২২ সালে ব্রাজিলে টিআই এর বিরুদ্ধে একটি নির্দিষ্ট দলের পক্ষ নিয়ে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা চালানোর অভিযোগ ওঠে। টিআই ব্রাজিলের কয়েকজন কর্মকর্তার একটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে টাকা নেয়ার প্রমাণ ও কথোপকথন ফাঁস হয়। এ অভিযোগে টিআই-এর বিরুদ্ধে মামলা চলছে ব্রজিলে। অথচ বাংলাদেশের টিআই এর প্রধান সব সময় বলার চেষ্টা করেন, টিআইবি কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে কাজ করে না। ড. ইফতেখারুজ্জামান ক’দিন আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরও এমন কথা বলেন। এবারও নিশ্চয়ই বলবেন।

 

যাই হোক লেখা শুরু করেছিলাম, দুর্নীতি এবং দূর্নীতির ধারণার সূচক বিষয়ক ধোঁয়াশা নিয়ে। এসে গেলো টিআইবির জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পেক্ষাপট। এবারের রিপোর্ট প্রকাশের আগেও তারা সেই ধোঁয়া পরিস্কার করেনি। আমার মনে হয় না করে ভালই করেছেন। এই সার্বিক আলোচনায় সাধারণ মানুষের কাছে তাদের এত সুশীল প্রীতির বিষয়টি নিশ্চয়ই পরিস্কার হয়েছে। সারা বিশ্বের মত তারাও নিশ্চয়ই এখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন।

 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *