বাণিজ্য বাড়াতে সরকারের পরিকল্পনা

দিনকাল বাংলাদেশ

বিশেষ প্রতিনিধি

 

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণকালীন সময়ে ১১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে রপ্তানি নীতির (২০২৪-২০২৭) নতুন খসড়া। এ সময়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বাজারগুলোতে দীর্ঘদিনের পাওয়া শুল্ক-কোটামুক্ত সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। ইউরোপের বাজারে দেশের পণ্য রপ্তানিতে নতুন করে ১০ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে রপ্তানিকারকদের। সীমিত হবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও’র) চুক্তির আওতায় বিশেষ সুবিধাগুলো। এসবসহ আরও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে নতুন রপ্তানিনীতি বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার।

 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সুত্রে জানা গেছে, রপ্তানি নীতির খসড়ার ওপর সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মতামতের পর চূড়ান্ত আকারে ঘোষণা দেওয়া হবে। আর ঘোষণার দিন থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ নীতি কার্যকর থাকবে। প্রতি তিন বছর অন্তর রপ্তানি খাতের জন্য এ নীতি প্রণয়ন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। শুল্কমুক্ত রপ্তানি, সরাসরি নগদ সহায়তা এবং মুদ্রা ধারণ স্কিমের মতো বেশ কয়েকটি সুবিধার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে বলে সরকার দেশের রফতানিকারকদের চাঙ্গা করতে এবং এলডিসি পরবর্তী সময়ে রফতানি-চালিত শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে আসন্ন রপ্তানি নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে চলেছে।

 

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে। রপ্তানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিদেশে আমাদের মিশনগুলোকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

 

আগামী তিন বছরে রপ্তানি ১১ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা থাকছে খসড়া রপ্তানিনীতিতে। এর মধ্যে রয়েছে একটি ডাটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে রপ্তানি-আমদানিকারক, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সরকারি ও বেসরকারি স্টেকহোল্ডারদের তথ্য আদান-প্রদান করা হবে।

 

আগামী ২০২৭ সাল পর্যন্ত রপ্তানি খাতে ১২টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানিতে আর্থিক প্রণোদনার বিপরীতে বিকল্প সহায়তা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর নগদ সহায়তা বন্ধ হবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

 

খসড়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নগদ প্রণোদনার বিকল্প হিসাবে প্রধান রপ্তানি পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ বিলে ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ ছাড়ের প্রস্তাব করেছে। মন্ত্রণালয় রপ্তানিকারক সংস্থাগুলোর জন্য সমস্ত লাইসেন্সিং ফি বাদ দেওয়ার এবং মূলধন এবং খুচরা সরঞ্জাম আমদানিতে মাত্র এক শতাংশ শুল্ক বহাল রেখে শুল্ক ছাড়ের প্রস্তাব করেছে। এতে রপ্তানিকারকদের ব্যবসার খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।

 

এছাড়া রপ্তানি খাতে স্বাভাবিক ঋণ প্রবাহ ও সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে স্থিতিশীল রাখা, রপ্তানিকারকদের নগদ সীমা নির্ধারণ করা হবে। পাশাপাশি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রপ্তানি ঋণ মনিটরিং কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূলত রফতানি ঋণের চাহিদার অঙ্ক নির্ধারণ, ঋণ প্রবাহ পর্যালোচনা করবে।

 

এছাড়া রাশিয়াসহ অন্যান্য সিআইএস দেশ, মিয়ানমার, ইরান এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবস্থা চালু করা হবে। এটি করা হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে রপ্তানি বাণিজ্যে লেনদেনে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। সেখানে আরও বলা হয়, এলসি কমিশন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার, নানা ধরনের সার্ভিস চার্জ, ব্যাংক গ্যারান্টি ও কমিশন সর্বনিু পর্যায়ে রাখা হবে।

 

খসড়া নীতিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। সেখানে বলা হয়, এ উত্তরণে বিনিয়োগ সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। পাশাপাশি রপ্তানি ও অর্থনৈতিক খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তির আওতায় কঠোর কপ্লায়েন্স ও সঠিক মানদণ্ড পালন করতে হবে। রপ্তানি খাতে নগদ প্রণোদনা দেওয়া থেকে সরে আসতে হবে।

 

সূত্র মতে, খসড়া নীতিতে তৈরি পোশাকশিল্পকে জিডিপি, রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের মূলভিত্তি হিসেবে শনাক্ত করা হয়। পণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের বাইরে খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যের বিকাশে সুপারিশ করা হয়। এই নীতিতে সেবা খাতের মধ্যে পর্যটন খাত, সফটওয়্যার, আইসিটি সার্ভিসেস ও বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংকে সম্ভাবনা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

 

খসড়া নীতিতে আরও বলা হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) কারণে আগামীতে বাংলাদেশে স্বল্প-দক্ষ শ্রম নিবিড় উৎপাদন প্রক্রিয়ার তুলনামূলক সুবিধা হারাবে। শ্রমনির্ভর খাতে কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কা থাকছে। প্রস্তুতি হিসাবে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি আইটি এনাবল সার্ভিসেস খাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।

 

এছাড়া রপ্তানি বাণিজ্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন, প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সহায়তা দিয়ে পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে বাণিজ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানো, মুক্ত বাণিজ্য, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন। লক্ষ্যের মধ্যে শিল্প খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের মান উন্নয়ন, আইসিটি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, ই-কমার্স, ই-গভার্নেন্স ও চতুর্থ বিপ্লবের কৌশল গ্রহণ করে রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

খসড়া রপ্তানি নীতিমালা অনুযায়ী, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজন হয় এমন রফতানিমুখী শিল্পে গ্রিন এনার্জি ইউনিট স্থাপনের জন্য ইডিএফ স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ দেবে। এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) ও পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণেও ঋণ দেওয়া হবে।

 

রপ্তানি শিল্পের জন্য বন্ড সুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়ে খসড়া নীতিমালায় রপ্তানি পণ্যের আমদানি করা কাঁচামালের ওপর শুল্কহার ক্রমান্বয়ে কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য একটি কেন্দ্রীয় বন্ডেড ওয়্যারহাউজ স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করে সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

 

আন্তঃসীমান্ত সেবা রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন করা হলে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হবে। একইভাবে বিদেশে সেবা প্রদানের পর ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আয় দেশে ফিরিয়ে আনলে রপ্তানিকারক রেমিট্যান্স প্রণোদনার হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রণোদনা পাওয়ার অধিকারী হবেন। বাংলাদেশি জাহাজে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করা হলে জাহাজ কোম্পানি ফ্রেইট চার্জের ওপর ভিত্তি করে ২ শতাংশ প্রণোদনা পাবে।

 

সেবা রফতানি বাড়াতে সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করবে সরকার। ই-কমার্সের মাধ্যমে রফতানি বাড়াতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, ই-কমার্সের মাধ্যমে রপ্তানি সম্পর্কিত বৈদেশিক মুদ্রা আয় সংগ্রহের জন্য একটি স্বাধীন, দক্ষ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পেমেন্ট সিস্টেম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এটি বাংলাদেশি পরিষেবা সরবরাহকারীদের রফতানি পরিষেবার জন্য বিদেশে অফিস, শাখা বা সহায়ক সংস্থা স্থাপনের অনুমতি দেবে।

 

বাংলাদেশে পর্যটন ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা হবে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে উন্নত আবাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হবে।

 

রপ্তানি জনবলের গুণগত মান বাড়াতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে। উপরন্তু, ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা যেমন ইংরেজি, চীনা ম্যান্ডারিন, ফরাসি, স্প্যানিশ, আরবি এবং জাপানি শিক্ষার প্রচারের চেষ্টা করা হবে। প্রস্তাবিত রপ্তানি নীতিমালা অনুযায়ী বেসরকারি ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা প্রদান করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *