বাংলাদেশের নির্বাচন ও বিশ্বমোড়ল আমেরিকার হস্তক্ষেপ

দিনকাল বাংলাদেশ

প্রফেসর ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী

চলতি বছরের ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদশের জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করে। এরপর ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদানকারী ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রদানের বিধি-নিষেধ আরাপের পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। এই ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। তার বিবৃতিতে উঠে এসেছে যে, ভিসা নীতির আওতায় সরকার সমর্থক, বিরোধীদল, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কয়েকদিন আগে ঘোষণা করা হয়েছে, সংবাদ মাধ্যমও এই নিষেধাজ্ঞা বা সাংশন এর আওতাভুক্ত। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস চ্যানেল-২৪’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিষয়টি পুর্নব্যক্ত করেন। যেটি অনেকাংশে আগুনে ঘি ঢালার শামিল। এ বিষয়ে বাংলাদেশের সম্পাদক পরিষদ ও এডিটরস্ গিল্ড যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ ঘোষণাকে স্বাধীন মত প্রকাশের পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে।

 

আমেরিকার এই অযৌক্তিক, অহেতুক ও অনধিকার হস্তক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি উত্তপ্ত। বিরোধী দল এ বিষয়কে অস্ত্র করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এই অপপ্রয়াস নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরের সময় ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। দেশের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আওয়ামী লীগের ছিলো। আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ তা প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই অবস্থার পরও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার এটাই প্রশ্ন যে, হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই, তারা আমাদের উপর ভিসা সাংশন দিতে চাচ্ছে কী কারণে?” জননেত্রীর এই সাহসী উচ্চারণ আমেরিকা ও নির্বাচন বিষয়ে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট বলে মনে করি।

 

একটি কথা প্রচলিত আছে, আমেরিকা যার বন্ধু তার কোনো শত্রুর প্রয়োজন নেই। অতীতের বাংলাদেশ ও ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে, এই সত্যের সারবত্তা স্পষ্ট হয়। কেননা বাংলাদেশের উন্মেষকাল থেকে আমেরিকার ভূমিকা ছিলো বৈরী। তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর ঘটনাও আমাদের মনে আছে। হতে পারে সাম্প্রতিক সাংশন ৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ। আমেরিকার অপচেষ্টা আমরা আরো স্মরণ করতে পারি ৭৪’র দুর্ভিক্ষের কারণও কিন্তু আমেরিকা। অর্থ দিয়ে কেনা গম বোঝাই জাহাজও তারা সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিলো। এছাড়া ৭৫’র বঙ্গবন্ধু হতাকাণ্ড সিআইএ এর ভূমিকাও প্রমাণিত।

 

বৈশ্বিক রাজনীতিতেও আমেরিকার ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড আমরা দেখেছি। ভিয়েতনামে তারা দশকের পর দশক যুদ্ধ করেছে। পোড়াামাটি নীতি প্রয়োগ করেছে। এছাড়া মার্কিনীদের অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়াসহ দেশগুলো এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশও হয়তো আমরিকার নতুন টার্গেট। কিন্তু আমেরিকার এই গাত্রদাহের কারণ কী? বাংলাদেশ এখন সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি রোল মডেল। উন্নয়নের যে মহাসড়কে বাংলাদেশ ক্রমশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা বিশ্বমোড়ল আমেরিকার অপছন্দ। পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ কোনো এক বিশেষ ব্লকে সীমাবদ্ধ নয়। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়’ বাংলাদেশ এই নীতিতে বিশ্ববাসী। সে কারণে চীনের সাথে সহযোগিতায় পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল বাস্তবায়ন করেছে। রাশিয়া থেকে ইতোমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ইউরেনিয়াম এসে পৌঁছেছে দেশে। শূন্য থেকে বাংলাদেশের পারমাণবিক জ্বালানিতে পদার্পণ। বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক উৎপাদনকারী এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৩য় রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দৈনিক ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এবং সৃষ্টি হবে ব্যাপক কর্মসংস্থানের। ভারতের সঙ্গেও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার। জাপানও বাংলাদেশর উন্নয়ন সহযোগী কিন্তু আমেরিকা চায় বাংলাদেশ কেবল তার উপর অতি নির্ভরশীল থাকুক। আমেরিকা সবসময় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে তাবেদার বানিয়ে রাখতে চায়।

 

এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য। আমেরিকা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সেন্ট-মার্টিন দ্বীপ চেয়েছিলো সামরিক ঘাঁটি করার জন্য। কিন্তু বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের ওই চাওয়া প্রত্যাখান করেছিলেন। আমেরিকা এখন আবার সেন্ট-মার্টিন দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি করতে চায়। কিন্তু জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা কোনো অবস্থাতেই এই প্রস্তাব মানতে রাজি নন। তিনি কখনো দেশের সার্বভৌমত্ব বিলীন করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চান না। সামাজ্রবাদী আমেরিকার কূটকৌশলের ধরন এখন পাল্টে গেছে। নব্য সামাজ্যবাদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ আমেরিকা এখন সেই আগ্রাসনের নতুন ফর্মুলা গ্রহণ করেছে। এই অপশক্তি হতে এসেছে নতুন অস্ত্র সাংশন বা ভিসা নিষেধাজ্ঞা।

 

আমেরিকার কারণে বহু প্রকল্পচুক্তি থেকে সরকার থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়ে হয়েছে। এছাড়া প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের আগে কেন এই ভিসা ইস্যু? সরকার বারংবার উচ্চারণ করেছে নির্বাচন হবে স্বচ্ছ-অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক। কিন্তু বিএনপিসহ কিছু সুবিধাবাদী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করতে দিবে না। তারা ঘোষণা করেছে এই নির্বাচন তারা প্রতিহত করবে। অথচ সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আর কোনো সুযোগ নেই। তাহলে আমেরিকা কি বিশেষ কোনো মহল বা তৃতীয় কোনো শক্তিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চায়? কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাচক্রকে প্রভাবিত করার জন্য বিএনপির তরফ থেকে হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট নিয়ে বিশেষ লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ় ও দূরদর্শী নেতৃত্বে, পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার সকল পথ নিশ্চয়ই বন্ধ করে দেবে। বাংলাদেশে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর ক্ষমতার আসতে হলে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই আসতে হবে। সরকার প্রধান দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে ঘোষণা করেছেন, নির্বাচন হবে সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য সকল বৃহৎশক্তি ও উন্নয়ন পার্টনারদের পর্যবেক্ষক টিম পাঠাতে বলেন। অতীতেও অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিলো, কিন্তু সুন্দর ও সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করা যায়নি। নিশ্চয়ই, আমেরিকার সাংশনও নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

 

এদেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। এতে ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্ত ও দু’লক্ষ মা- বোনের সম্ভ্রম হারানোর ক্ষতও আছে। এদেশের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রাণ হারিয়েছেন স্বয়ং জাতির পিতার পরিবার। জাতীয় নেতৃবৃন্দ। পথ হারিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। আবার সম্ভিত ফিরে পায় বেঁচে থাকা বঙ্গবন্ধুর জ্যৈষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ’কে। সরকার প্রধান হয়েছেন চার বার। এই ধারাবাহিকতা ১৫ বছর। শত বাধা আতিক্রম করে বাংলাদেশ এখন বিশ^ অর্থনীতিতে ৩১তম স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশ এখন এক অবিস্মরণীয় উন্নয়নের দেশ। কোভিড-অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও মেগা প্রকল্পগুলো অব্যাহত আছে এবং দৃশ্যমানও হয়েছে অনেক। দীর্ঘ সরকার পরিচালনায় হয়তো কিছু ভুল বা ব্যর্থতা থাকতে পারে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় দু’একটি নির্বাচন হয়তো ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক হয়নি। এরকম উদাহারণ স্বয়ং আমেরিকায়ও দেখি। অনবরত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সবক দেওয়া আমেরিকার গত নির্বাচনও কলঙ্কিত হয়েছে ক্যাপিটাল হিলের হামলায়।

 

এতদসত্ত্বেও গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নির্বাচনের বিকল্প নেই। শত ভিসা নীতি ও সাংশন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারবে না। সাংশন চ্যালেঞ্জ কখনো ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে কঠিন হবে না। বৃহৎ স্বার্থের জন্য জনগণকে কিছু ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হতে পারে, যেটি হবে সাময়িক। বাঙালি কখনো গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দিতে পারে না। বাঙালির পরম স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা শেখ হাসিনার হাতে স্মার্ট বাংলাদেশ হয়ে গড়ে উঠবেই।

 

লেখক: প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *