খুলনা বিভাগ ও খুলনা বিভাগের ইতিহাস

বাংলাদেশ

কালপুরুষবাংলাদেশের ৮ টি বিভাগের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায় ২২,২৮৫ বর্গ কিলোমিটার নিয়ে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম বিভাগ খুলনা বিভাগ।যার জনসংখ্যা ১,৫৬,৮৭,৭৫৯ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব ৬৯৯ জন প্রতি কিলোমিটার (২০১১ আদমশুমারি) যা জনসংখ্যার দিক থেকে খুলনা বিভাগের নাম পঞ্চম স্থানে তুলে আনে। খুলনা বিভাগের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে রয়েছে খুলনা শহর যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের রুপসা এবং ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত।  ব্রিটিশ ভারতে খুলনা বিভাগ ছিল প্রেসিডেন্সি বিভাগের একটি অংশ। ১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গ সরকার  কর্তৃক খুলনা জেলা সহ যশোর ও কুষ্টিয়া জেলাকে রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত করা হয়। আবারো ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বদৌলতে রাজশাহী বিভাগের খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া এবং ঢাকা বিভাগের থেকে বরিশাল নিয়ে বিভাগ হিসেবে খুলনার যাত্রা শুরু হয়। খুলনা বিভাগ প্রথমে ১৬ টি জেলা নিয়ে গঠিত হলেও ১৯৯৩ সালে খুলনা বিভাগের অন্তর্গত থাকা বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরগুনা এই ছয়টি জেলা আলাদা হয়ে বরিশাল বিভাগের গঠন হয়। বর্তমান খুলনা বিভাগ ১০ টি জেলা নিয়ে গঠিত। এরা যথাক্রমে:- খুলনা, যশোর, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মাগুরা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা।

বিভাগের সব থেকে বড় জেলা খুলনা যা দেশের মধ্যেও তৃতীয় বৃহত্তম শহর। খুলনা বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা কুষ্টিয়া। খুলনা বিভাগের, বিশেষ করে খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকেন্দ্রিক এলাকা হিসেবে দেশের বাকি সকলের কাছে পরিচিত। প্রধান শিল্প নগরী হওয়ায় খুলনাকে বাংলার কুয়েত সিটি ও বলা হয়।

বাংলাদেশের প্রাচীন নদীবন্দর গুলোর মধ্যে খুলনা অন্যতম। খুলনার নদীর বুকে ১৯৯২ সাল থেকে স্টিমার চলাচল শুরু হয় যা খুলনাকে আরো উন্নত শহরে পরিণত হতে সাহায্য করে। খুলনা শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরেই  মংলা সমুদ্র বন্দর অবস্থিত যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং দ্বিতীয় ব্যস্ত সমুদ্র বন্দর। এই মংলা সমুদ্র বন্দরের বদৌলতে চট্টগ্রামের পর খুলনাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দরনগরী ও বলা হয়। এছাড়াও দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর যা খুলনা বিভাগের যশোরে অবস্থিত। রাজধানী ঢাকার সাথে স্থলপথে খুলনার দূরত্ব ৩৩৩ কিলোমিটার। খুলনার শিল্প এলাকা সচল রাখতে এই সড়ক যোগাযোগ এবং নদীমাতৃক যোগাযোগের কোন বিকল্প নেই। যা কাঁচামাল ও বিভিন্ন পণ্য আমদানি রপ্তানিতে বড় ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রাচীন রেলপথ এবং চিনিকল কেরু এন্ড কোম্পানি যা চুয়াডাঙ্গাতে অবস্থিত। বাংলাদেশের অন্য যে কোন বিভাগের সাথে খুলনা বিভাগের জলপথ, স্থলপথ বা আকাশপথে যোগাযোগ সম্ভব এবং যা অন্যান্য বিভাগের তুলনায় অনেক উন্নত।

খুলনা বিভাগ শিল্প এলাকা হলেও এখানে রয়েছে অনেক দর্শণীয় স্থান যা প্রতি বছর অনেক ভ্রমণ পিপাসুদের আকর্ষণ করে। এখানে রয়েছে ষাট গম্বুজ মসজিদ যা বাগেরহাটে অবস্থিত, খুলনায় অবস্থিত রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বাড়ি যা রবীন্দ্র কমপ্লেক্স নামেও পরিচিত, যশোরে রয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভিটা এবং কুষ্টিয়ায় রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ভিটা, এবং লালন শাহের মাজার,  চুয়াডাঙ্গাতে রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের ভিটা। এছাড়াও ভ্রমণের জন্য সুন্দরবন তো আছেই।খুলনা কে সুন্দরবনের দ্বারপদ বলা হয় । সব মিলিয়ে খুলনা বিভাগকে পর্যটন কেন্দ্রিক বিভাগও বলা যায়।

আমাদের অতীত এবং বর্তমানের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জন্ম এই খুলনা বিভাগে। এদের মধ্যে রয়েছে যতীন্দ্রমোহন বাগচী, আবু সালেহ, গোলাম মোস্তফা, কাজী কাদের নেওয়াজ, সৈয়দ আলী আহসান, ফররুখ আহমেদ, সিকান্দার আবু জাফর প্রমুখ যারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে অনেক কবিতা, উপন্যাস, গল্পের সৃষ্টি করে গেছে।

চিত্র জগতের খুলনা বিভাগের মানুষ অনেক পরিচিত। প্রথম মুসলিম চিত্র নায়িকা বনানী চৌধুরীর জন্ম এই খুলনা বিভাগে। এছাড়াও আরো বিখ্যাত চিত্রনায়িকা যেমন ববিতা, সুচন্দা, মৌসুমী, চম্পা, শাবনূর, পরীমনির জন্ম এই খুলনা বিভাগ।

ক্রীড়াঙ্গনেও খুলনা বিভাগের অসাধারণ সাফল্য রয়েছে। বাংলাদেশ পুরুষ ক্রিকেট টিমে খুলনা বিভাগ থেকে রয়েছে মাশরাফি বিন মর্তুজা (সাবেক খেলোয়াড় বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম),সৈয়দ রাসেল(সাবেক খেলোয়ার বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম), হাবিবুর বাসার সুমন (সাবেক খেলোয়াড় বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম), জিয়াউর রহমান (সাবেক খেলোয়াড় বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম), আব্দুল রাজ্জাক(সাবেক খেলোয়াড় বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম), সাকিব আল হাসান, সৌম্য সরকার,  মেহেদী হাসান মিরাজ, রুবেল হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান,   ইমরুল কায়েস, এনামুল হক বিজয়ের নাম লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট টিমে রয়েছে সালমা খাতুন যিনি বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক। তিনি ছাড়াও রয়েছে রুমানা আহমেদ, জাহানারা আলম, শারমিন রত্না, শুকতারা রহমানের মতো তারকা খেলোয়ার, যারা আজও খুলনা বিভাগের নাম উজ্জ্বল করে চলেছে।

খুলনা বিভাগের নামকরনের ইতিহাস

খুলনা সদরের নামে খুলনা বিভাগের নামকরণ করা হয়েছে। এই খুলনার নামকরণে অনেক মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। খুলনা নামের কিভাবে উৎপত্তি হলো তা নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতামত লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে প্রধান প্রধান যে মতামত গুলো খুঁজে পাওয়া যায় তা হল:- ধনপতি সওদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রী খুলনার নামে নির্মিত ‘খুলনেশ্বরী মন্দির’ থেকে খুলনা নামের উৎপত্তি। ১৭৬৬ সালে ‘ফলমাউথ’ জাহাজের নাবিকদের উদ্ধারকৃত রেকর্ডে লিখিত Culnea শব্দ থেকে খুলনার নামকরণ হয়। অনেক বিজ্ঞজনের মতে ‘কিসমত খুলনা’ মৌজা থেকে খুলনা নামের উৎপত্তি হয়েছে।  আবার বৃটিশ আমলের মানচিত্রে লিখিত Jessore-Culna শব্দ থেকে খুলনা এসেছে বলেও অনেকের ধারণা। তবে এরমধ্যে কোনটি সত্য তা এখনও গবেষণার বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *