শেখ হাসিনাতেই আস্থা আবারও প্রমাণ করল বাংলাদেশ

দিনকাল বাংলাদেশ

আবু জাফর মিয়া

 

৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের মাধ্যমে টানা চতুর্থ বারের মত সরকার গঠন করেছে। মন্ত্রীসভাও গঠন করা হয়েছে। টানা চারবারসহ মোট পঞ্চমবারের মত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে সকলেই শপথ নিয়েছেন। শুরু হয়েছে নতুন সরকারের কার্যক্রম।

 

কিন্তু নতুন সরকারের পথচলা খুব একটা মসৃণ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। কেননা নব গঠিত সরকারের উপর দেশী-বিদেশী নানা মহলের যেমন ব্যাপক চাপ রয়েছে, তেমনি তাদের উপর জনগণের রয়েছে পাহাড়সম প্রত্যাশা। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে নির্বাচন সুষ্ঠ হয়নি মর্মে টিআইবিসহ নানা দেশী-বিদেশী সংস্থা প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। নির্বাচনে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে ঘটে নাই, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পৃথিবীর অধিকাংশ গণিতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনে কিছু না কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেই থাকে। যদিও তা যেমন কারো কাম্য নয়, আবার কোনভাবেই তা গ্রহণযোগ্যও নয়। তবে নির্বাচনকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, বিশ্বাসযোগ্য ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য করার লক্ষে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগ ছিল চোখে পড়ার মত। তার সবচেয়ে বড় প্রমান হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে অসাদাচারণ করায় চট্টগ্রাম-১৬ আসনের নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থীতা ভোটের দিন শেষ মূহুর্তে বাতিল করা হয়েছে। এছাড়াও, আওয়ামী লীগ দলীয় ও এর সমমনা দলের বাঘা বাঘা প্রার্থীদের হারিয়ে ৬২ জন স্বতন্ত্র সাংসদ নির্বাচিত হওয়াও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশই বটে। অনেকে বলেন, নির্বাচন নিয়ন্ত্রিত ছিল। তাই যদি হয়, তাহলে তাদের জোটের অন্যতম ও দীর্ঘদিনের শরীক জেপির প্রর্থী আনোয়ার হোসেন মঞ্জ ৩৬ বছর পর জীবনে প্রথমবারের মত হারতেন না। আবার পুলিশের বর্তমান আইজিপি এর ভাই আব্দুল্লাহ আল-মামুন সুনামগঞ্জ-২ আসনে নৌকার প্রার্থী হয়েও ভোটের লড়াইয়ে হেরে যেতেন না। এ রকমের আরো বেশ কিছু উদাহরণ দেয়া যাবে।

 

যাহোক, জনগণের প্রাত্যাশা মেটাতে সরকারকে যেমন সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তেমনি সেগুলোর যথোপযুক্ত বাস্তবায়নও করতে হবে। সরকার এ প্রক্রিয়া অবলম্বনে শতভাগ আন্তরিক থাকবে বলেই সকলের প্রত্যাশা।

 

সকলেই অবগত যে, বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বিধায় সংবিধান মোতাবেক শেখ হাসিনা নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন বর্জন করেছে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে নানা সময়ে নানা কর্মসূচি দিয়েছে। এমনকি সরকার পতনের উদ্দেশ্যে কয়েকবার ডেট লাইন পর্যন্ত দিয়েছে।

 

শুধু তাই নয় নির্বাচন কমিশন যাতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে না পারে, সেজন্য তারা হরতাল-অবরোধ এর মত কর্মসূচি প্রায় ধারাবাহিকভাবে দিয়েছে এবং এ সকল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে অগ্নি সন্ত্রাসসহ উল্লেখযোগ্য কিছু সহিংস ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

 

বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো নির্বাচনে না আসায় নির্বাচনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষে আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত করা। সেজন্য তারা বেশ প্রচার-প্রচারণাও চালায়। কিন্তু ভোটের আগে হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে সহিংস কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন ধরনের নাশকতার কারণে জনমনে কিছুটা আতঙ্ক দেখা দেয়।

 

এছাড়া তীব্র শীতসহ উপরোক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা কম ছিল। নির্বাচন কমিশনের তথ্য মোতাবেক এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮০ শতাংশ। এ নির্বাচনকে বানচাল কিংবা বাধাগ্রস্ত করতে সরকার বিরোধী দলগুলো অনড় ছিল। তারা অসহযোগ আন্দোলনের মত কর্মসূচী দিয়েছে।

 

নির্বাচন আগে ও পরে শেখ হাসিনার সরকার নিয়ে অপপ্রচারে দেশি-বিদেশি নানা মহল ও মিডিয়া বেশ সক্রিয় আছে। শেখ হাসিনাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই সমালোচনা চলে। পক্ষান্তরে, তার নেতৃত্বগুণ নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রশংসাও হয়।

 

কিন্তু সরকার বিরোধী দলগুলোর এত আন্দোলন, হরতাল-অবরোধ, অসহযোগ আন্দোলনের মত কর্মসূচীগুলো কেন সফল হচ্ছে না। কিংবা কোন কোন বিদেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতা থাকার সত্ত্বেও তারা সফল হতে পারছে না। এর মূলে কয়েকটি বিষয় ভূমিকা রাখছে বলে অনেক বিশ্লেষকরা মনে করছে। প্রথমত, বিরোধীদের দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্বের অভাব।

 

দ্বিতীয়ত, হরতাল-অবরোধ চলাকালীন সময়ে বাস-ট্রেনে নাশকতাসহ অগ্নি সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানুষ হত্যা। কোন যৌক্তিক দাবি এক সময় হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে আদায় করা হতো। কিন্তু বর্তমানে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে হরতাল-অবরোধের মত এক সময়ের সফল কর্মসূচি জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। এর মূল কারণ এ সকল কর্মসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণ খুবই কম।

 

মূলত এ কর্মসূচিগুলো অতি মাত্রায় সহিংস হওয়ায় সাধারণ মানুষ এ সকল কর্মসূচি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তৃতীয়ত, অতিমাত্রায় এ সকল কর্মসূচি ঘোষণা করা। চতুর্থত, কর্মসূচি ঘোষণার পরে তা বাস্তবায়নের জন্য কর্মীদের উপস্থিতি থাকলেও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব সব সময়েই ছিল।

 

পঞ্চমত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন। এক সময় দেশে বিদ্যুতের অবস্থা ভয়াবহ ছিল। বর্তমানে বিদ্যুতের অবস্থা খুব ভালো।  প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও মানুষ এখন প্রায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পায়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে।

 

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা বিমান বন্দরে ৩য় টার্মিনাল নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণসহ বহু মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় দেশের বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী, প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী মহিলা, জেলে, বেদেসহ অনেক কে ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। চাকুরী বাজার থেকে দুর্নীতি অনেকটাই দূর করেছেন। বহু মানুষকে চাকুরী দেয়ার মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন।

তবে শেখ হাসিনার সরকার গত আমলে  সবক্ষেত্রে সফল ছিলেন বলা যাবে না।  দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি ছিলেন অনেকটাই ব্যর্থ। অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট কে নিয়ন্ত্রণ করতে অসহায়ত্বের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির আরও একটি কারণ হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ।

 

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যসহ অল্প কিছু জায়গায় শেখ হাসিনার ব্যর্থতা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল। তিনি আসলে একজন সত্যিকারের যোদ্ধা। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা আনয়ন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বেশ কিছু খাতে অগ্রাধিকার দেয়াসহ একটি জনকল্যাণমুখী নির্বাচনী ইশতিহার দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

 

সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছে যে এই ইশতিহারের বাস্তবায়ন শেখ হাসিনার দ্বারাই সম্ভব। কেননা তিনি কথা দিয়ে সে কথা রাখেন। তাই তো শত বাধা এবং খারাপ আবহাওয়া উপেক্ষা করেও প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে এবং  আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে যদি জনরোষ থাকত, তাহলে তো শ্রীলঙ্কার মত সাধারণ মানুষের আক্রমণের স্বীকার হতে হতো শেখ হাসিনার সরকারকে। সংসদ নির্বাচনের পরে সাধারণ মানুষের সরকারের বিরুদ্ধে কোন ধরনের নেতিবাচক মনোভাব দৃশ্যমান হচ্ছে না। অধিকন্তু, বলা যায় সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে জনতা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি গণমানুষের আস্থা আবারো এতে প্রমাণিত হলো।

 

বিদেশী মিডিয়ার কাছে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় ঐভাবে দৃশ্যমান নয়। কিংবা দূর থেকে সবকিছু বুঝাও সম্ভব নয়। তাই তারা শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করে। কিন্তু দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে শেখ হাসিনার নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং আপোষহীন মনোভাব অন্যদের থেকে তাকে আলাদা করেছে। জনগণের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দায়বদ্ধতা ও ভালোবাসার প্রতিদান তিনি প্রতিনিয়ত পেয়ে যাচ্ছেন। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সর্বশেষ নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্ত থাকলেও নির্বাচন নিয়ে জনগণের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গিয়েছে।

 

নবগঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য আরও আশার কথা হচ্ছে-ভারত, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, জাপান, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বহু দেশ ইতোমধ্যে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন,  জাতিসংঘের মহাসচিব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক পিটার ডি হাস, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

 

এছাড়াও অনেক উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা নতুন সরকারের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। নতুন সরকার সাধারণ মানুষের সমর্থন এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচনে ঘোষিত ইশতিহারের বিষয়গুলো বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার সরকার চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্তরিকতা দেখাবে সে প্রত্যাশা সকলের। নতুন সরকারের প্রতি অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।

 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *