প্রতিবেদনের নামে টিআইবির এজেন্ডাভিত্তিক গবেষণা

দিনকাল বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের গবেষণায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ‘একপাক্ষিক ও পাতানো’ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দাবি করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক হয়নি বলে জানিয়েছে। তবে টিআইবি’র এই গবেষণায় বেরিয়েছে নানা অসংগতি এবং তথ্যের গড়মিল। তাদের গবেষণা পদ্ধতিকে এজেন্ডাভিত্তিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই তারা ব্যক্তিগত মতামতকে তথ্য হিসেবে উল্লেখ করেছে।

 

টিআইবি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এটি একটি মিশ্র পদ্ধতির গবেষণা। গুণগত ও সংখ্যাগত উভয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

 

গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত প্রত্যক্ষভাবে নিয়েছে। মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী, দলীয় নেতা-কর্মী, রিটার্নিং কর্মকর্তা, কমিশনের কর্মকর্তা, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, নির্বাচনী ট্রাইবুনালের কর্মকর্তা, স্থানীয় সাংবাদিক, ভোটার, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি থেকে নির্বাচন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা জরিপ করেছে টিআইবি।

প্রত্যক্ষ তথ্য যাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক আছেন। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোন অসংগতির বার্তা আসেনি। বরং বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে জানিয়েছেন।

 

টিআইবি পরিমাণগত ফলাফলসহ তার রিপোর্ট দিয়েছে। যদিও মেথোডলজি সেকশন (সেকশন ৩, পৃষ্ঠা ৩) থেকে দেখা যাচ্ছে যে তারা তাদের সিদ্ধান্তে আসার জন্য গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় ডেটা ব্যবহার করেছে। তারা কীভাবে পরিমাণগত ফলাফলে এসেছে তার কোনও প্রক্রিয়া উল্লেখ নেই।

 

টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, তারা ৩০০টির মধ্যে ৫০টি নির্বাচনী এলাকার তথ্য নিয়েছে। কিন্তু তারা কতোগুলো ভোট কেন্দ্রের তথ্য নিয়েছে তার উল্লেখ নেই। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ৪২ হাজার ৩৫০টি ভোটকেন্দ্র ছিল। তাদের পদ্ধতি কীভাবে কার্যকর ধরা যায়, যখন তারা কতগুলো ভোট কেন্দ্রের তথ্য নিয়েছে, সেই সংখ্যাটিই প্রকাশ করেনি। তাদের ছিল মাত্র ৩ জন গবেষক এবং ৪ জন গবেষণা সহকারী। এত অল্প সময়ে এত ছোট টিম দিয়ে নির্বাচনের পুরো মেকানিজম জরিপ তারা কীভাবে করতে পারলেন এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

 

মতামতকে তথ্য হিসেবে উল্লেখ করেছে টিআইবি। ৩০০ আসনের মধ্যে দৈবচয়নে ৫০টি আসন নিয়ে গবেষণা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিসের ভিত্তিতে তারা এই ৫০টি আসন বেছে নিয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করেনি। কাদের কাছ থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করেছে তাও উল্লেখ করেনি। যাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে তারা মূলত অংশীজন। তারা তথ্য নয়, মতামত দিয়েছে। তথ্য এবং মতামতের মধ্যে পার্থক্য আছে। তারা মতামতকে তথ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। টিআইবি ৫০টি আসনের মধ্যে কতোগুলো কেন্দ্র বা পোলিং বুথে তথ্য সংগ্রহ করেছে তারও উল্লেখ নেই।

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪২ হাজার ৩৫০টি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। পোলিং বুথ ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৫টি। তারা কতোগুলো বুথে গবেষণা করেছে তা উল্লেখ না করে প্রতিবেদনের উপংহারে পৌঁছে বলেছে ৫১ শতাংশ আসনে পোলিং বুথে প্রকাশ্যে ভোট দেয়া হয়েছে। গায়েবিভাবে তারা এই তথ্য উপস্থাপন করেছে।

তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেছেন, আন্তর্জাতিক কোনো জার্নাল তাদের এই গবেষণা প্রকাশ করবে না। কারণ এই গবেষণায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা হয়নি। টিআইবির গবেষণা বৈজ্ঞানিক মিসকন্ডাক্টকে (অসদাচরণ) ছাড়িয়ে গেছে। তারা অসত্য তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।

 

তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের সুশীল সমাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে গবেষণা করবে এবং তার ফলাফল জনগণের সামনে তুলে ধরবে। টিআইবি যেটা করেছে, সেটা গবেষণা না, এটা তাদের মতামত।’

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনালজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘দেশে সমানুপাতিক আচরণের বিষয়টা বেশ অনুপস্থিত। যেমন- একজনের বক্তব্যে যদি কাউকে খারাপ বলা হয় তাহলে সে খারাপ হয়ে গেল। বর্তমানে বাংলাদেশে এক ধরনের সুশীল সমাজ তৈরি হয়েছে যারা তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। এসবের মধ্যে বেশ কিছু ভালো বিষয় থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক কিছু আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে। বাংলাদেশে নির্বাচন কিংবা তার আগ মুহূর্তে এই বিষয়টা বেশ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এক সময় দেখতাম সুশীল সমাজ নির্মোহভাবে বক্তব্য দিতো , এখন আমরা সেই নির্মোহ জিনিসটিকে হারিয়ে ফেলেছি।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘টিআইবি আগে একটি গবেষণা করেছিল। সেই গবেষণার তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে আমরা তিনজন শিক্ষক অসংগতিগুলো তুলে ধরেছিলাম। তার গবেষণাটি করেছিল সংসদ সদস্যদের নিয়ে। সেখানে অজস্র ভুল ছিল, গবেষণায় কোন স্ট্যান্ডার্ড মেথোডলজি ব্যবহার করা হয়নি। এখন টিআইবি’র দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে করা গবেষণা প্রতিবেদন দেখে আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগছে। একটি হচ্ছে তারা যে কথাগুলো বলেছে তার অধিকাংশ হচ্ছে মতামত। মতামত প্রকাশের জন্য কিন্তু গবেষণার প্রয়োজন হয় না। তাদের গবেষণা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য ও সঠিক- তিনটি মানদণ্ডের উপর আমরা বলে থাকি যে একটি গবেষণা কতটুকু মানসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য। সেগুলো তো তারা কিছুই উল্লেখ করেনি। আমি গবেষণার কোন কিছুই দেখিনি এর মধ্যে। মূল কথা হচ্ছে- টিআইবি’র গবেষণায় আমরা গবেষণার মূল যে তাত্ত্বিক বিষয় সেটি কিন্তু দেখিনি ‘

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *