যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে একাকিত্বের মাত্রা কিশোর বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এবং ২০০৭ সালের দিকে বাজারে আইফোন আসার পর থেকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে।
প্রযুক্তির যেমন ভাল দিক রয়েছে তেমনি মন্দ দিকও রয়েছে। অন্যসব কিছুর ব্যবহারের মতো আমরা বর্তমানে ২ কোটি ২৬ লাখ মানুষের বেশি মোবাইলের মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার করি। উই আর সোস্যাল ইস্যুটির দেয়া তথ্য মতে, ফেসবুক ব্যবহারের দিক থেকে রাজধানী ঢাকা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে প্রচুর ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে এবং ঐসব কিশোর-কিশোরীর ফেসবুক ব্যবহার তাদের পড়ালেখায় প্রভাব বিস্তার করছে তা বলাই বাহুল্য। ফেসবুক তাদের বই পড়ার আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। যে সময়টাতে তাদের বই নিয়ে লেখাপড়া করার কথা, সেই সময়টাতে তারা ফেসবুকে বা ম্যাসেঞ্জারে বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাতে ব্যস্ত। অথবা কোনো ছবি আপলোডে ব্যস্ত সময় পার করছে।
নতুন নতুন যত আবিষ্কার হচ্ছে ততই মানুষ প্রকৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে যান্ত্রিকতায় মগ্ন হয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির কারনে আমরা যেন আজ যন্ত্রের দখলে। অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া আজকের জীবনযাত্রা প্রায় অচল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। অতএব পরবর্তী প্রজন্মকে এই দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সঙ্গে প্রস্তুত করাও জরুরি।
জার্মানিতে এক উদ্যোগের মাধ্যমে সেই চেষ্টাই চালানো হচ্ছে। দিনে চব্বিশ ঘণ্টার একটি বড় অংশই কাটছে প্রযুক্তির সঙ্গে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারকারী দের অধিকাংশই তরুণ। আজকাল কিশোর-তরুণদের প্রায় সবার হাতে হাতে মোবাইল ট্যাব। চোখের মণি সর্বসময় সেসব ডিজিটাল প্রযুক্তির পর্দায় স্থির হয়ে আছে। বাসে, রেলে যেখানেই যাচ্ছি সব জায়গাতে একই দৃশ্য।
আবেগ অনুভূতি জানানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফেসবুক, টুইটার। ফেসবুক এর মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। কেউ একজন আত্মহত্যা করবে তার পূর্বে সে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দিচ্ছে। সেসব নিয়ে পরদিন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকি আজকাল ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বলতেও কিছু নেই। প্রতিদিন অসংখ্য মেয়ের সর্বনাশ হচ্ছে এই সোসালমিডিয়ার মাধ্যমে। মানুষের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো ফেসবুকে আপলোড করে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেখিয়ে আদায় করা হচ্ছে অর্থ।
আবার কেউ কেউ তা ফেসবুকে ছেড়েও দিচ্ছে। অনেক কিশোরী পারিবারিক মর্যাদা রক্ষার কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলো এর জীবন্ত সাক্ষী। সোসালমিডিয়ার কল্যাণে আজকাল আমরা সবাই এক প্রকার বন্দি জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। মা-বাবা ভাই-বোন সবাই যেন বন্ধুর কাতারে। ভাচুয়াল ফ্রেন্ড জগতে কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেখতে পারে না। কেবল লাইক কমেন্ট পর্যন্তই করতে পারে। খুব বেশি হলে শেয়ার করার সুযোগ পাওয়া যায়।
আমাদের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ ফেসবুকে ব্যস্ত থাকার কারণেই বলা যায়, তাদের চিন্তা-ভাবনার বড় একটি অংশ ফেসবুকে ব্যয় করছে। যেখানে তাদের চিন্তুা-ভাবনা কোনো সৃষ্টিশীল কাজে হওয়া উচিত, সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনোদনের কাজেই তাদের সময় অপচয় করে চলছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে শতকরা ৯৩ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর এর মধ্যে। ফেসবুক ব্যবহারে তরুণদের অংশগ্রহণ কোনো দুশ্চিন্তা থাকার কথা নয়।
আমাদের চিন্তার বিষয় হলো এই ফেসবুক ব্যবহার করতে গিয়ে যেন টেক্সট বুক ব্যবহারটা না আবার হারিয়ে যায়। পাঠ্যবই পড়ার হার আগের তুলনায় এখন রীতিমতো উদ্বেগজনক হারে কমছে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে দেয়া শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই এ কথা বলে থাকেন। তবে এ কথাও সত্য যে, এই তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আবার ফেসবুককে টেক্সট বুকের বিকল্প হিসেবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে আসছে।
লাইক চ্যাটের বাইরেও যে এর ব্যবহার রয়েছে তা দেখিয়ে দিয়েছে অনেকে। ফেসবুকে গড়ে উঠছে বিভিন্ন স্টাডি গ্রুপ। ব্রিটিশ এক লেখক সতর্ক করে বলেন, টুইটার, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বুকার পুরস্কার বিজয়ী লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকবসনের কাছ থেকে জানা যায়, স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং অধিক পরিমাণে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কারণে নাটকীয়ভাবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যোগাযোগের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে আর এসব কারণে তারা বই পড়ার অভ্যাস হারাচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে শুধু তরুণ প্রজন্মের কথাই বলেননি, বরং সেই সঙ্গে তার নিজের অবস্থাও তুলে ধরেছেন। তিনি নিজেও বইয়ের প্রতি আর আগের মত তেমন মনোযোগ দিতে পারেন না। তার মনোযোগের একটা বড় অংশ চলে যায় মোবাইল কম্পিউটারের স্ক্রিনের পর্দায়। প্রতিবেদনে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, আমরা আগামী ২০ বছরের মধ্যে এমন শিশুদের পাব যারা বই পড়তে পারবে না।
আজকের কম্পিউটার প্রযুক্তির যুগে আমাদের চোখ দিনের অধিকাংশ সময়ই কম্পিউটারের মনিটরে স্থির হয়ে থাকে। কম্পিউটারে থেকেও বেশি সময় স্মার্টফোনের পর্দায় থাকে। প্রথমে আমরা কম্পিউটারে কিবোর্ডের কল্যাণে হাতের লেখা ভুলতে বসেছি। বিশ্বের উন্নত দেশের একটি স্কুলে নাকি পরীক্ষা ল্যাপটপে নেয়া হবে। কারণ তাদের হাতের লেখা যাচ্ছেতাই অবস্থা। একটা সময় আমাদের বাংলাদেশে ডাক হরকরা ছিল। তারা যত্নে লেখা চিঠি প্রিয়জনের ঠিকানায় পৌঁছে দিত। বর্তমানে মোবাইল এসএমএসের যুগ। পরীক্ষা ছাড়া এখন হাতে লেখা প্রায় হয়েই ওঠে না।
ভবিষৎ এ এমন কোনো প্রজন্ম কি আসবে, যখন তারা কেউ বর্ণমালা সঠিকভাবে লিখতে পারবে না। সেটা হতেই পারে। তবে সেদিনটা আমাদের জন্য নিশ্চয়ই খুব দুঃখজনক হবে। তখন আর বাবা-মা বর্ণমালা নিয়ে পেন্সিল ঘুরিয়ে সন্তানকে সঠিকভাবে অক্ষর লেখা শেখাবেন না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষার মান আগের চেয়ে অনেক নেমে গেছে। ১৯৮২ সালের পর চল্লিশ বছরের মধ্যে গত বছরই প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সাহিত্য পড়ার হার সবচেয়ে কম। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত বছরের তথ্য অনুযায়ী মাত্র ৪৩ শতাংশ মানুষ বছরে মাত্র একটি বই পাঠ করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিদিনই তরুণদের অনলাইনে কাটানো সময়ের হার বাড়ছে। ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সীরা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৫ ঘণ্টা অনলাইনে সময় কাটায়।
ফেসবুকের মাধ্যমেও লেখাপড়া করা বা পাঠ্যবইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ শেয়ার করে বন্ধুদের সঙ্গে পড়ালেখা করা কোনো কঠিন বিষয় নয়। তবে সেটা খুব কমই সময়ই হচ্ছে। তারা মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক দিকটাই বেছে নিচ্ছে তরুণরা। তরুণদের ফেসবুক ব্যবহার কেবল সীমাবদ্ধ রয়েছে লাইক, কমেন্ট আর পোক দেয়ার মধ্যে। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৩৩ লাখের বেশি সোসাল মিডিয়া ব্যবহারকারী রয়েছে। এই ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৯১ শতাংশই ফেসবুক ব্যবহার করে। যার ১ কোটি ৭০ লাখ পুরুষ এবং ৬৩ লাখ নারী। অর্থাৎ যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এই জরিপের বাইরেও অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে।