প্রধানমন্ত্রীর অনুভূতির পরতে পরতে যে রাসেল

দিনকাল বাংলাদেশ

উদিসা ইসলাম

“১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্ম হয় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় আমার শোয়ার ঘরে। দোতলা তখনও শেষ হয়নি। বলতে গেলে মা একখানা করে ঘর তৈরি করেছেন। একটু একটু করেই বাড়ির কাজ চলছে। নিচতলায় আমরা থাকি। উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার ও কামালের। সেই ঘরেই রাসেল জন্ম নিল রাত দেড়টায়। রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা কাকা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার এবং নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আর জেগে ওঠে। আমরাও ঘুমে ঢুলঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা।”

 

২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছোট্ট রাসেল সোনাকে নিয়ে নিজে এই অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন

কীভাবে রাসেল নামটি এলো সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী লেখেন, আমাদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রাসেল। অনেক বছর পর একটা ছোট বাচ্চা আমাদের ঘর আলো করে এসেছে, আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। আব্বা বার্ট্র্যান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে নিজের ছোট সন্তানের নাম রাসেল রাখলেন। ছোট্ট রাসেল আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। মা রাসেলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সংসারের কাজ করতেন, স্কুল বন্ধ থাকলে তার পাশে শুয়ে আমি বই পড়তাম। আমার চুলের বেণি ধরে খেলতে খুব পছন্দ করতো ও। আমার লম্বা চুলের বেণিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতাম। ও হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হাসতো।

 

ছোট ভাইকে হারাতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ১৯৭৫ সালে ঘাতকেরা ছোট্ট রাসেলকেও রেহাই দেয় নাই। মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিলো রাসেল, শেষ সময়ে। তার শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়নি। সেই রাসেলের প্রথম হাঁটার স্মৃতি উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর লেখায়। তিনি লিখেছেন, একদিন আমার হাত ধরে হাঁটছে। ওর যেন হাঁটার ইচ্ছা খুব বেড়ে গেছে। সারা বাড়ি হাত ধরে ধরে হাঁটছে। হাঁটাতে হাঁটতে পেছনের বারান্দা থেকে সামনের বারান্দা হয়ে বেশ কয়েকবার ঘুরলো। এই হাঁটার মধ্যে আমি মাঝে মাঝে চেষ্টা করছি আঙ্গুল ছেড়ে দিতে, যাতে নিজে হাঁটতে পারে। কিন্তু সে বিরক্ত হচ্ছে, আর বসে পড়ছে, হাঁটবে না আঙ্গুল ছাড়া। তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমি বরাবরই চেষ্টা করছি যদি নিজে হাঁটে। হঠাৎ সামনের বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে আমার হাত ছেড়ে নিজে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে চলছে। আমি পেছনে পেছনে যাচ্ছি। সেই প্রথম হাঁটা শুরু করল। আমি ভাবলাম কতটুকু হেঁটে আবার আমার হাত ধরবে। কিন্তু যতই হাঁটছি দেখি আমার হাত আর ধরে না, চলছে তো চলছেই, একেবারে মাঝের প্যাসেজ হয়ে পেছনের বারান্দায় চলে গেছে। আমি তো খুশিতে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করেছি যে, রাসেল সোনা হাঁটতে শিখে গেছে।

 

প্রধানমন্ত্রীর লেখায় ফুটে উঠে ওইটুকু বয়সের রাসেলের মধ্যে যে মায়া সত্তা ছিলো। শেখ হাসিনা লিখছেন রাসেলের কবুতরের মাংস না খাওয়ার গল্প। আমাদের বাসায় কবুতরের ঘর ছিল। বেশ উঁচু করে ঘর করা হয়েছিল। অনেক কবুতর থাকতো সেখানে। মা খুব ভোরে উঠতেন, রাসেলকে কোলে নিয়ে নিচে যেতেন এবং নিজের হাতে কবুতরদের খাবার দিতেন। রাসেল যখন হাঁটতে শেখে তখন নিজেই কবুতরের পেছনে ছুটত, নিজে হাতে করে তাদের খাবার দিত। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও কবুতর ছিল। কবুতরের মাংস সবাই খেত। বিশেষ করে বর্ষাকালে যখন অধিকাংশ জমি পানির নিচে থাকতো তখন তরকারি ও মাছের বেশ অভাব দেখা দিত। তখন প্রায়ই কবুতর খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। সকালের নাস্তার জন্য পরোটা ও কবুতরের মাংস ভুনা সবার প্রিয় ছিল। তাছাড়া কারও অসুখ হলে কবুতরের মাংসের ঝোল খাওয়ানো হতো। ছোট ছোট বাচ্ছাদের কবুতরের স্যুপ করে খাওয়ালে রক্ত বেশি হবে, তাই বাচ্চাদের নিয়মিত কবুতরের স্যুপ খাওয়াতো। রাসেলকে কবুতর দিলে কোনও দিন খেত না। এত ছোট বাচ্চা কিভাবে যে টের পেত কে জানে। ওকে আমরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। ওর মুখের কাছে নিলেও খেত না।

 

সেই শিশুটি বড় হয়েছিলো রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসনের শিক্ষক ড. জেবউননেছার লেখায় পাওয়া যায় সেই চিত্র। তিনি লিখছেন, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাড়ির বারান্দা থেকে মিছিল দেখে বলতো ‘জয় বাংলা’। পুলিশ দেখলে বলতো ‘ও পুলিশ কাল হরতাল’। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ তাদের বাড়িতে দুষ্কৃতকারীরা গুলি করলে সে গুলি শেখ রাসেলের পায়ের কাছে এসে পড়ে। তিনি বেঁচে যান। ছোট শিশুটি ১৯৭১-এর যুদ্ধে মায়ের সঙ্গে গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। আকাশে মেঘের মতো এয়ার রেইডের শব্দ হলে তুলো নিয়ে বোনের ছেলে জয়ের কানে গুজে দিতো। পাকসেনাদের অস্ত্র পরিষ্কারের পদ্ধতি জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে একসময় অস্ত্রের নাম শিখে ফেলেছিলেন। ১৯৭১’র বিজয়ের দিন রাসেল এবং তার চাচাতো ভাই টিটো দুই জন হেলমেট পরে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলেছিল। যে ছবি এখনও জীবন্ত। বন্দিদশা থেকে বাবা মুক্ত হয়ে যেদিন আসেন, সেদিন দাদার হাত ধরে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন বাবাকে আনতে। তবে রাসেল অভ্যস্ত ছিল বাবাকে না পেতে পেতে।

 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *