বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার পঞ্চমবারের মতো শপথ নেয়ায় তাঁর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেখানো বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে আবার স্মরণ করাতে চেয়েছেন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট রাম মাধব। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত একটি লেখায় তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে বাঙালিদেরকে মুক্ত করেননি, তিনি নবগঠিত দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির নৈতিকতা স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন।
৫২ বছর আগে, ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নবগঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। আর তাঁর সন্তান শেখ হাসিনা গত ১১ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পঞ্চমবারের মতো শপথ নেন। নিজের লেখায় ঐতিহাসিক দুটি দিনকে গণতন্ত্রের পথে যাত্রার যোগসূত্রে গাঁথতে চেয়েছেন রাম মাধব।
পাকিস্তান কখনোই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে পারেনি বলে মনে করেন রাম মাধব। দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ওয়েস্টমিনস্টার-মডেল গণতন্ত্র চেয়েছিলেন। কিন্তু তা সেই দেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি বলা যায়। সূচনার প্রথম দশকে দেশটির সংবিধানই ছিল না। তখন এটি ভারত সরকার আইন ১৯৩৫ অনুযায়ী পরিচালিত হয়েছিল।
১৯৫৬ সালে এসে প্রথমবারের মতো একটি সংবিধান জারি করতে পেরেছিল পাকিস্তান। কিন্তু ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল আইয়ুব খানকে ক্ষমতায় আনায় তা ছিল স্বল্পস্থায়ী। ৭৫ বছরের পথ চলায় পাকিস্তান সামরিক শাসনের অধীনেই প্রায় অর্ধেক সময় কাটিয়েছে। এমনকি দেশটিতে যখন তথাকথিত নির্বাচিত সরকার ছিল, তারাও সবসময় সামরিক বাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে রাম মাধব নিজের লেখায় মনে করিয়ে দিয়েছেন।
একের পর এক সামরিক শাসনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপক বৈষম্যের সম্মুখীন হওয়ার যুগকে স্মরণ করে রাম মাধব লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির অধিকারের জন্য রুখে দাঁড়ান এবং সামরিক স্বৈরশাসকদের হাতে নিপীড়নের শিকার হন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন লাহোরে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার আশায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ভোটাররা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পেছনে দাঁড়ায়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ সদস্যের জাতীয় পরিষদে ১৬৬টি আসন জয় করে।
বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠনের আহ্বান জানানোর পরিবর্তে, ইয়াহিয়া খান তাঁকে ১৯৭১এর ২৫ মার্চ কালরাতে গ্রেপ্তার করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হয়। এই পরিস্থিতিতেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে লড়াই শুরু হয়। রাম মাধব লিখেছেন, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতীয় বাহিনীকে আক্রমণ করে, তখন ভারতের হস্তক্ষেপে পাকিস্তান বাহিনীর অপমানজনক পরাজয় ঘটে। পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়।
১০ মাস পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বিজয়ী প্রত্যাবর্তনের জন্য লন্ডন ত্যাগ করার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হিথ্রো বিমানবন্দরে দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন যে “আমি নিজেকে কখনই পাকিস্তানী ভাবিনি এবং কখনই তা ভাববো না”। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে এমন নীতির ভিত্তিতে তৈরি করতে, যা দেশটিকে পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে তুলবে। মাতৃভূমিতে তাকে স্বাগত জানাতে আসা কয়েক মিলিয়ন জনতার উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার এই স্বাধীনতা বৃথা হবে, যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পায়, যদি বাংলার মা-বোনেরা সম্মান রক্ষার জন্য পোশাক না পায়, যদি আমার যুবকরা চাকরি না পায়। বাংলাদেশকে একটি দৃঢ় আর্থিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করাকে বঙ্গবন্ধু তার জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন বলে জানিয়েছেন রাম মাধব।
পাকিস্তানের অশুভ ছায়া বাংলাদেশের এড়াতে না পারাকে দুর্ভাগ্য হিসেবে উল্লেখ করেন রাম মাধব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যখন ভারত তার স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছিল, তখন বাংলাদেশের কিছু কুচক্রী সেনা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করে তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী এবং তিন পুত্রসহ তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হত্যা করে, যাদের মাঝে সবচেয়ে ছোটজন শেখ রাসেলের বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। রাম মাধব লিখেছেন, জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি পরে ওই বছরের নভেম্বরে ক্ষমতা দখল করেন, তিনি সরাসরি উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের বলেছিলেন, “আমি একজন সিনিয়র অফিসার। আমি এর সাথে জড়িত হতে পারি না। যদি কোনো জুনিয়র অফিসার এটি করতে চান, এগিয়ে যান”।
বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছার বিপরীতে পাকিস্তানের ধাঁচে সামরিক স্বৈরাচারে পতিত হয় বাংলাদেশ এবং তা ১৫ বছর ধরে টিকে থাকে। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর সামরিক স্বৈরশাসক হন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং প্রায় এক দশক ধরে সেই ভূমিকা অব্যাহত রাখেন। সেই সময়ে, জিয়াউর রহমানের পার্টি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি পরপর সরকার পরিচালনার পাশাপাশি প্রহসনের নির্বাচনকে স্বাভাবিক বিষয় করে তোলে।
রাম মাধব লিখেছেন, ১৯৯০ সালে ছাত্রদের একটি বড় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সেনাবাহিনীকে তার ব্যারাকে ফিরে যেতে বাধ্য করে এবং বাংলাদেশ গণতন্ত্র ফিরে পায়। গত তিন দশকে, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেছে। আওয়ামী লীগ ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার দৌড়ে এগিয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পুরো পরিবারকে হত্যা করার সময় শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা ইউরোপে ছিলেন। দুই বোনকে দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী আশ্রয় দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন কিন্তু বহু বছর ধরে সামরিক শাসনের নিপীড়ন ও গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হন তিনি। অবশেষে, ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র ফিরে আসার সাথে সাথে, তিনি দুই বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের একজন হয়ে ওঠেন এবং এ পর্যন্ত ২০ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় তাঁকে আরও পাঁচ বছরের মেয়াদ দিয়েছে। একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর জন্য পঁচিশ বছর ক্ষমতায় থাকাকে রেকর্ড বলে উল্লেখ করেছেন রাম মাধব।
জীবনের নানা অভিজ্ঞতা শেখ হাসিনাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে বলে মত রাম মাধবের। শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে তাঁর মনোযোগ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটি চমৎকার স্তরে নিয়ে আসে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয় বাংলাদেশ। দেশটি মাথাপিছু জিডিপি, হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্স এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতা সূচকের মতো মাপকাঠিগুলোতে তার প্রতিবেশীদের চেয়ে এগিয়ে।
তারপরও বাংলাদেশের গণতন্ত্রে দুর্বলতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়ে গেছে বলে মনে করছেন রাম মাধব। তিনি বলেছেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বর্জন এবং সহিংসতার কারণে সাম্প্রতিক নির্বাচন বিঘ্নিত হয়েছে। বিএনপির নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তকে কেউ সমর্থন করতে পারে না। পশ্চিমা কিছু মহলের সমালোচনা সমর্থনযোগ্য নয়। রাম মাধবের বক্তব্য, শেখ হাসিনাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তিনিই একমাত্র নেত্রী যিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র টেকানোর এবং দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে এবং তাঁর পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সক্ষম।