করোনা

করোনা রোগী বাড়ছে সীমান্ত এলাকায়, আইসিইউ ও শয্যা সংকট

বাংলাদেশ স্বাস্থ্য
গত কয়েকদিনে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাসহ উত্তর ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে করোনার সংক্রমণ, শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়েছে। রোগীর চাপ বেড়েছে বিভিন্ন জেলায় করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে। শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছেন অনেক হাসপাতালে। অনেকে শেষ মুহূর্তে এসে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। চিকিৎসকেরা তাঁদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। চাহিদা অনুযায়ী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সেবা পাচ্ছেন না অনেক রোগী। করোনা সংক্রমণ বাড়ে যাওয়ায় দেশের দুটি জেলা সম্পূর্ণ এবং সাতটি জেলায় এলাকাভিত্তিক লকডাউনের আওতায় আনা হয়েছে।
এর পাশাপাশি দুটি জেলায় বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে মানুষ উদাসীন লকডাউন ঘোষিত এলাকায়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন সীমান্তসহ দেশের কয়েকটি জেলায় করোনা পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে সামনে সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সকলের সমন্বিত উদ্যোগের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরা জেলায়। করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি আরও ছয়টি জেলা লকডাউন করার সুপারিশ করেছেন। জেলাগুলো হল রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহ ধরে করোনায় আবার মৃত্যু বেড়েছে। এছাড়া দেশের উত্তর ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলেও মৃত্যু সংখ্যা বেড়েছে। বিভাগওয়ারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার হার রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি। গত সপ্তাহের তুলনায় রাজশাহীতে মৃত্যু ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। মৃত্যু বাড়ার হারে রাজশাহীর পরেই আছে খুলনা বিভাগ। এখানে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ। আর ঢাকা বিভাগে প্রায় ৩৫ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ৩ শতাংশ ও রংপুরে ৬ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে। অন্যদিকে সিলেট, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কমেছে মৃত্যু।
দেশে গত মে মাসে পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর থেকে করোনা সংক্রমণে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায়। তুলনামূলকভাবে সংক্রমন বেশি বেড়েছে ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে। গত ৮ মে দেশে প্রথম ভারতীয় ধরণ শনাক্ত হয়। সরকারি গবেষণায় দেখা যায়, দেশে করোনার ৫০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪০টি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। সরকারের এই গবেষণাতে ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ হিসেবে পরিচিত ভারতীয় ধরনের সামাজিক সংক্রমণেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের (এনসিডিসি) পরিচালক মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, সংক্রমণ বন্ধ করতে পারাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সামনে আরও সংক্রমণ বেড়ে যায় কি না, সেটাই বড় দুশ্চিন্তা। অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়েছে সংক্রমণ বেশি থাকা জেলাগুলোতে। হাসপাতালগুলোতে শয্যা, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
পুরো লকডাউন দুই জেলায়
গত মে মাসের ২৫ তারিখ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় লকডাউন চলছে। এর মধ্যেও অবনতি ঘটছে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির। জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার সংক্রমণের হার ছিল ৫৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। আগের দিন সংক্রমণের গড় হার ছিল ৪১ দশমিক ৬০ শতাংশ।
গতকাল শহরের নিমতলা মোড়, ডাকঘর, পুরাতন বাজার মোড়, বড় ইন্দারা মোড় এবং থানার সামনে মানুষ ও যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক অবস্থার কাছাকাছি ছিল। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খোদ সদর থানা ফটকের সামনেই জটলা করে মানুষজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। অনেকের মুখেই ছিল না মাস্ক। যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না লকডাউনের বিধিনিষেধ। রিকশা, অটোরিকশা চলাচলও আগের চেয়ে বেড়ে গেছে।
দুদিন আগেই ২৫০ শয্যা বেডের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে শয্যাসংখ্যা ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শয্যা করা হয়। আজ থেকে শয্যা বাড়িয়ে ৫০ এ উন্নীত করা হবে। করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসক মো. শাখাওয়াত বলেন, ওয়ার্ডে ১২ জন রোগীর জটিল অবস্থা। এদের মধ্যে তিনজনের খুবই খারাপ অবস্থা। তাঁদের জরুরী আইসিইউতে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া দরকার। আইসিইউ সুবিধা নেই এই হাসপাতালে। চাইলেও রাজশাহীতে পাঠানো যাচ্ছে না। সেখানেও আইসিইউতে শয্যা ফাঁকা নেই।
গতকাল শনিবার সকাল ছয়টা থেকে সাতক্ষীরায় লকডাউন শুরু হয়েছে। লকডাউনে বিভিন্ন রকম বিধিনিষেধ দেওয়া হলেও তা মানতে দেখা যায়নি সেভাবে। সাতক্ষীরা শহরে চলাচল করছে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস। কলারোয়ার কাজির হাট ও তালা উপজেলার পাটকেলঘাটায় এবং সাতক্ষীরা সীমান্তে বসানো হয়েছে দুটি পাহারাচৌকি।
সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, লকডাউনের প্রথম দিন আইন কার্যকরে কিছু পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। আমসহ অন্যান্য কাঁচা মাল পরিবহনের ওপর বিধিনিষেধ নেই।
অনীহা স্বাস্থ্যবিধি মানায়
নোয়াখালী পৌরসভা ও সদর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ঘোষিত এক সপ্তাহের লকডাউন শুরু হয়েছে গতকাল শনিবার সকাল ছয়টা থেকে। তবে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস ও দোকানপাট বন্ধ রাখা ছাড়া জনজীবনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি এই বিশেষ লকডাউন।
শহরের প্রধান সড়ক ও বিভিন্ন শাখা সড়কে দেখা যায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের দখলে রয়েছে সব সড়ক। শহরের প্রবেশদ্বারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা তেমন চোখে পড়েনি।
নোয়াখালী জেলা করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম বলেন, মানুষজনের অবাধে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলোতে সর্বোচ্চ দুজন যাত্রী পরিবহনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে সরেজমিনে দেখা যায় অটোরিকশায় চালকসহ ছয়জন চলাচল করতে।
করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় মোংলা উপজেলাকে বিধিনিষেধের আওতায় আনা হয়েছে। গতকাল শনিবার থেকে মোংলা উপজেলায় বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে মাঠে নেমেছে কোস্টগার্ড।
মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বলেন, শনিবার মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে ৪৮ জনের মধ্যে ৩৪ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে। এই হিসাবে উপজেলায় সংক্রমণ হার শতকরা ৭১ ভাগ।
গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার সাহাপুর, বৌলতলী, সাতপাড় ইউনিয়নের একাংশে গতকাল লকডাউনের নবম দিন ছিল। স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না এসব এলাকার লোকজন। এসব এলাকায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। অনেকে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন।
নিয়ামতপুর উপজেলা ও নওগাঁ পৌরসভায় সর্বাত্মক লকডাউন ও জেলার আরও তিনটি উপজেলায় কঠোর লকডাউন আরোপের তৃতীয় দিন ছিল গতকাল। গতকাল আগের দুদিনের তুলনায় রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কিছুটা বেশি ছিল।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের সাতটি গ্রামে অনির্দিষ্টকালের লকডাউন চলছে। গতকাল নতুন করে তালিকায় যুক্ত হয়েছে পার্শ্ববর্তী কুড়ুলগাছি ও পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের নয়টি গ্রাম। এই নয়টি গ্রামে লকডাউন দেওয়া হয়েছে ১৪ দিনের জন্য। তবে লকডাউন দেওয়ার পরও মানুষকে ঘরে থাকছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *