আইনের পথে হাঁটলেই মুক্তি পেতে পারেন খালেদা জিয়া

দিনকাল বাংলাদেশ

কঙ্কা কনিষ্কা

দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে নেয়া নিয়ে চলছে নানা ব্যাখ্যা অপব্যাখ্যার ফুলঝুরি। বিএনপি এবং বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলছেন সরকার ইচ্ছে করে আইনি জটিলতায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করাতে দিচ্ছে না। আর অন্যান্য আইনজ্ঞরা বলছেন সরকার চাইলেই যা খুশি তাই করতে পারে না। সংবিধান এই স্বেচ্ছাচারের অধিকার কাউকে দেয় না। চলুন পাঠক আমরা দেখে নেই এনিয়ে কী বলেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা এবং কী আছে আইনে।

 

আলোচনার সুবিধার জন্যে আমরা সরকারের আইনমন্ত্রীর বক্তব্য জেনে নিতে পারি। গত ৪ অক্টোবর সচিবালয়ে সাংবাদিকেদের তিনি বলেন, এখন আইনের পথে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার পথ বন্ধ। তবে তিনি যদি দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চান, সেটা রাষ্ট্রপতি বিবেচনায় নিতে পারেন। এনিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলেন, আইনমন্ত্রী বা সরকার আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আইন অনু্যায়ী খালেদা জিয়াকে সরকারই মুক্তি দিতে পারে। বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী কায়সার কামাল বলেন,ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় বলা আছে, সরকার চাইলেই নির্বাহী আদেশে যে কাউকে মুক্তি দিতে পারে এবং বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারে।

 

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ওই ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

 

এনিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হলে খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি আবেদন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে আগের আদেশ প্রত্যাহার করে নতুন আদেশ জারি করতে হবে। এখানে আগের আদেশ বলতে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও খালেদা জিয়াকে বাসায় চিকিৎসা নেয়ার যে সুযোগ দেয়া হয়েছে সেটার কথা বলা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল সে ক্ষেত্রে কিন্তু কিছুটা জটিলতা আছে। সেই আদেশ প্রত্যাহার হলে তিনি আর বাইরে থাকতে পারবেন না। কারাগারে ফিরে যেতে হবে। তার পর সেই আবেদন বিবেচনায় আনা হবে।

 

এখন আসি নিরেট আইনে। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে বিনাশর্তে বা শর্তসাপেক্ষে কারও দণ্ড স্থগিত করতে পারে। স্থগিতাদেশের সময় বাড়াতে পারে। আবার শর্ত ভাঙলে যে কোনো সময় স্থগিতাদেশ বাতিল করে দিতে পারে। আইনের উপধারা ১এ বলা হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে, সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যা মেনে নেয়, সেই শর্তে তার দণ্ড কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারবেন। আর উপধারা-৫ এ বলা হয়, রাষ্ট্রপতি চাইলে তার কাছে যে কোন দণ্ডপ্রাপ্তকে ক্ষমা করতে পারেন। এছাড়া তিনি সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দণ্ড স্থগিত রাখতেও পারবেন। তবে সবার আগে দণ্ডপ্রাপ্তকে দোষ স্বীকার করে আবেদন করতে হবে।

 

সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম মাসুম বিল্লাহ জানান, খালেদা জিয়ার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত  আক্ষরিকভাবে ঠিক আছে। কিন্তু এতে কিছু ভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। এই ভ্রান্তি দূর করতে কিছু বিষয় আলোচনা হওয়া দরকার। যেমন আইন বলছে, ক্ষমা প্রদর্শন বা শাস্তি কমানো কিংবা মওকুফ করা সরকারের নির্বাহী বিভাগের একটা গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম কাজের অনুশীলন। কোনো অনিশ্চিত বা অস্পষ্ট ব্যাপারে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা অনুশীলন করা উচিত নয়। কেননা, বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশন আইন বা ভিসা আইনে দণ্ডিত ব্যক্তিকে সাধারণত ভিসা দেয়া হয় না। দিলেও সেটা প্রতিষ্ঠিত একটা ব্যতিক্রমের মধ্যে পড়তে হবে। অপরাধীর দণ্ড স্থগিতকরণ বা হ্রাসকরণ অপরাধীকে নির্দোষ বানিয়ে দেয় না। তার দণ্ডাদেশ সক্রিয় থাকে। তাই ধরা যাক রাষ্ট্র যদি, কোনো দণ্ডিতের সাজা স্থগিত করে বা কমিয়ে তাকে বিদেশ যাবার অনুমতি দেয়, সেই দেশের ইমিগ্রেশন আইন ১৭ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে।

 

এই অনিশ্চয়তার কারণে, রাষ্ট্রীয় নির্বাহী-সার্বভৌম ক্ষমতা অন্য দেশের ভিসা আইনের মুখাপেক্ষী করা যায় না। প্রার্থী তার আবেদনে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য-দেশের নাম উল্লেখ না করলে এই অনিশ্চয়তা বাড়ে। এই জটিলতার সঙ্গে আর একটা অভ্যন্তরীণ আইনি দিক যুক্ত আছে উল্লেখ  ব্যাখ্যা করে মাসুম বিল্লাহ বলেন, পাসপোর্ট আদেশ ১৯৭৩-এর মুখবন্ধে বলা আছে যে, পাসপোর্ট ব্যবস্থা পরিচালিত হবে ‘জনস্বার্থে’। এই আইনে  নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি কোনো অপরাধে কমপক্ষে দুই বছর দণ্ডিত কোনো ব্যক্তি পাসপোর্ট পাবার যোগ্য নন। নবায়নের ক্ষেত্রেও সেই একই আইন প্রযোজ্য।

 

তিনি বলেন, এখন খালেদা জিয়া যদি সত্যিই বিদেশে যেতে চান এবং তার মেডিক্যাল রিপোর্ট সাপোর্ট করে তাহলে একটাই আইনি পথ খোলা আছে। সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির কাছে দাক্ষিণ্য আবেদন করা। ৪০১ ধারার অধীনেও সরকারের কাছেও দণ্ড মওকুফের আবেদন সম্ভব। তবে একটা কারণেও ৪০১-এর অধীনে মওকুফ আবেদন কোনো কাজে আসবে না, তা হলো ৪০১-এর মওকুফ আবেদনকারীকে নির্দোষ করে না। সুতরাং তার আইনজীবীদের প্রথমেই আদালতের রায় মেনে নিতে হবে।

 

আইনজ্ঞ মাসুম বিল্লাহ তার পর্বেক্ষণে বলেন, খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা  আইনের পথেই হাঁটছেন না। তারা যতটা না খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তার চেয়ে বেশি বিএনপির আইনজীবী। তাদের কথায় মনেই হয না যে খালেদার বিচার আইন অনুযায়ী হয়েছে। তারা তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেয়ে প্রমাণ করতে চান যে, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বিনা কারণে জেলে আছেন। অথচ যে মামলায় তিনি সাজা প্রাপ্ত হয়েছেন সেই মামলার সঙ্গে সরকারের কোন যোগসূত্রই নেই। মামলা করেছিল ২০০৭ এর তত্বাবধায়ক সরকার।

 

বিএনপির আইনজীবীদের হোমওয়ার্ক বাড়াতে বলেন মাসুম বিল্লাহ। আমাদের ভাবতে হবে, ‘তিনবারের প্রধানমন্ত্রী’ যুক্তি জ্ঞাত আইনবিজ্ঞানের কোনো ফর্মুলায় পড়ে না। বরং ‘তিনবারের প্রধানমন্ত্রী’ হবার কারণেই তার ক্ষেত্রে ৪০১ ধারা সতর্কভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত। ওই পয়েন্টে বার বার তারা হেরে যাবেন। মানবিক গ্রাউন্ড কথাটা ঠিক হয় না। কারণ ৪০১ ধারা নিজেই একটা মানবিক ধারা। যার বেনিফিট খালেদা জিয়া নিচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, এটা স্কুলের টিউশন ফি কমানোর কোনো দরখাস্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে, গ্রাউন্ডটা হবে, মানবাধিকার গ্রাউন্ড। খালেদা জিয়ার বর্তমান বয়স,করোনা সার্কামস্টেন্সেস, রাইট টু লাইফ, রাইট টু হেলথ, রাইট টু ডিউ প্রসেস, প্রিজাম্পশন অব ইনোসেন্স, বেনিফিট অব টু কনস্ট্রাকশন ইত্যাদি গ্রাউন্ডে ৪০১-এর আবেদন করতে হবে।

 

এখন দেখা যাক যদি সত্যিই খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্যে বিদেশে নিতে হয় তাহলে কী করতে হবে তাঁর পরিবারকে। প্রথমে এই মামলায় উচ্চ আদালতের আপিল প্রত্যাহার করতে হবে। পরে রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে। রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা পেলেই কেবল, ফৌজদারি দণ্ড প্রশমন হয়, এবং দণ্ডিত তার হারানো সিভিল অধিকারগুলো ফেরত পান। তখন আর সেটা ইমিগ্রেশন আইন বা ভিসা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় না। আর তখনই কেবল আবেদনকারী বিদেশে যেতে পারেন।

 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *