google play

দেশের তৈরি অ্যাপের বাজার এখন হাজার কোটি টাকার

তথ্যপ্রযুক্তি বাণিজ্য
স্মার্টফোন চালু করলে পর্দায় সামনে অনেক ধরনের অ্যাপ ভেসে ওঠে। বেশিরভাগই বিদেশি অ্যাপ। ভালো করে তাকালে দেখা যাবে আমাদের দেশি অ্যাপও আছে। হয়তো আপনার মোবাইলে আর্থিক সেবার অ্যাপ আছে এবং যা দিয়ে আপনি লেনদেন করেন। হয়তো ব্যাংকের আবার একটা অ্যাপও রয়েছে। যে মোবাইল অপারেটরের সিম বা সংযোগ নিয়মিত ব্যবহার করছেন সেই কোম্পানির অ্যাপটিও আছে। তা দিয়ে রিচার্জ করছেন, ইন্টারনেট ডেটা কিনছেন, প্রিয়জনকে বান্ডল উপহার পাঠিয়ে দিচ্ছেন। রাইড সেবা নেওয়ার অ্যাপও দেখা যায় কোনও না কোনও। এসবই হলো দেশি অ্যাপ। বলা যায় আপনার অগোচরেই যথেষ্ট অনেক বড় হয়েছে দেশি অ্যাপস বাজার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বাজারের আকার বলতে গেলে এখন অন্তত হাজার কোটি টাকা।

 

রফতানির কথাগুলো বাদ দিলেও দেখা যাবে দেশের অ্যাপের বাজার অনেক রমরমা। সরকারি অ্যাপের চাহিদা তো সেই সাথে আছেই। এই খাতের সফলতা দেখে সুদূরপ্রসারী চিন্তাও করে যাচ্ছে সরকার। মোবাইল অ্যাপ এবং গেমসের ওপর রীতিমতো প্রশিক্ষণ দিয়ে ডেভেলপার তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে ১৬ হাজারের বেশি প্রশিক্ষণার্থীকে এই পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আগামীতে নতুন ধরনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ডেলিভারি সিস্টেম, ই-কমার্স,  গণমাধ্যম, বিনোদন, স্বাস্থ্যসেবা, অনলাইন টিকিটিং, ট্রাভেল, শিক্ষা,  রাইড শেয়ারিং, ওষুধ সরবরাহ ইত্যাদি দেশে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘দেশি অ্যাপের বাজার এখন অনেক বেশি বিস্তৃত। এই সময়কার টেকনোলজির ভোক্তারা যেকোনও সার্ভিসের সেবা প্রায় শতভাগই তাদের স্মার্টফোনটির মাধ্যমে পেতে আগ্রহী। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি যে, মোবাইল ব্যাংকিং, বিনোদন, অনলাইন টিকিটিং, ই-কমার্স প্রভৃতিতে অ্যাপের ব্যবহার অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। আমরা আমাদের সরকারি সেবাগুলোকেও মোবাইল অ্যাপে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।

 

আমাদের দেশের নতুন ডেভেলপাররাই কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের অনেক অ্যাপ্লিকেশনগুলো তৈরি করছে। এর বাজার এতোই বেশি বড় হয়েছে যে, মোবাইল অ্যাপের ধারণা এখন আর শুধুমাত্র ইনফরমেটিভ অথবা ট্রানজেকশন লেভেলের অ্যাপ তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর সঙ্গে মোবাইল ভিডিও গেম ও টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (VAS) যুক্ত হয়ে দেশীয় বাজারেই এটা প্রায় হাজার কোটি টাকার মার্কেটে পরিণত হয়েছে।’

 

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে গেমসের মার্কেট প্রায় ১৫২ বিলিয়ন ডলারের। সেই মার্কেটটিতে প্রবেশ করার জন্য আমরা ভিডিও গেমস ডেভেলপমেন্টের ওপর প্রায় ১৬ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফেলেছি। আরও প্রায় ১০ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অ্যাপভিত্তিক এন্ট্রাপ্রেনরশিপগুলোও দেশে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে ‘

 

সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইনোভেশন ফান্ড, স্টার্টআপ ফান্ড এবং আইডিয়া প্রজেক্টের আওতায় এসব ইনোভেটিভ বিজনেস আইডিয়াগুলোতে প্রায় ফান্ডিং করছি। একই সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবা এবং অটোমেশনের সুবিধার্থে অ্যাপ ভিত্তিক সলিউশনগুলো তৈরির ক্ষেত্রে আমরা ওই প্রতিষ্ঠানের হয়ে কনসালটেশন এবং মনিটরিংয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সব ফান্ড সরবরাহ করছি।

 

এখন যেকোন ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিশেষ করে সেবা ভিত্তিক হলে একটি ওয়েবসাইট যেমন থাকে নরমালি তেমনি অ্যাপ থাকাও অনেকটা প্রচলিত নিয়মের মতো হয়ে গেছে। ব্যাংক, টেলিকম অপারেটরগুলো অ্যাপের মাধ্যমে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। অ্যাপ থেকে মোবাইল রিচার্জও করা যাচ্ছে অনায়সে, অন্যকেও রিচার্জ দেওয়া যাচ্ছে এবং উপহারও দেওয়া যাচ্ছে। হিসাবও রাখা যাচ্ছে সবগুলো খরচের। কয়েকটি ব্যাংক আবার বাসায় বসে অ্যাপ ডাউনলোড করে হিসাব খোলারও ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সফটওয়্যার এবং সেবা পণ্যের নির্মাতাদের সংগঠন বেসিসের সভাপতি বলেন, ‘দেশি অ্যাপের বাজার অনেক বড় হচ্ছে। অনেকেই এখন আগ্রহী হচ্ছেন অ্যাপ তৈরি করতে। যারা শুধু ওয়েবসাইট বানাতেন তারা এখন আবার অ্যাপও তৈরি করছেন। এটা ভালো একটি অগ্রগতি।’

 

দেশি অ্যাপ ডেভেলপাররা কেমন কাজ করছেন জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘দেশে যেসব অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে তার বেশিরভাগই ধরতে গেলে দেশেই তৈরি। আমাদের ডেভেলপাররা আন্তর্জাতিক মানের যেকোনো অ্যাপ তৈরির সক্ষমতা রাখেন। তারা দেশের পাশাপাশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্যও অ্যাপ বানাচ্ছেন।’

 

বাংলাদেশের মানুষ ব্যবহার করে এমন শীর্ষস্থানীয় ৫০টি সেরা ওয়েবসাইটের তালিকা প্রকাশ করেছেন ওয়েবসাইট রেটিং প্রতিষ্ঠান অ্যালেক্সা। এর মধ্যে প্রায় ২০টিই বাংলাদেশের অ্যাপ। এর মধ্যে ১৫টি বিভিন্ন ধরনের সংবাদপত্র এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালের। আর বাকি ৫টি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের যেম – বিডিজবস, দারাজ, বিক্রয় ডট কম,  টেলিটক, পোর্টাল ডট গভ. বিডি।

 

এদিকে আবার টপ অব স্ট্যাক সফটওয়্যার নামের ওয়েবসাইট দেশের শীর্ষ জনপ্রিয় কয়েকটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে।  এরমধ্যে রয়েছে কানেক্ট ব্যাকআপ, হাফিজি কুরআন ১৫ লাইনস, প্রেয়ার টাইম-কুরআন-কিবলা ও তাসবিহ,  কিডস লার্ন বাংলা অ্যালফাবেট, বিকাশ, রিদমিক কি-বোর্ড,  পাঠাও। এদিকে দেশিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশি অ্যাপের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তার মধ্যে রয়েছে সেবা ডট এক্সওয়াইজেড(Sheba.xyz), উবার, পাঠাও, হাংগ্রিনাকি, ডক্টরোলা, চালডাল, দারাজ, ফুডপান্ডা, সহজ ডট কম ও বিক্রয় ডট কম।
জনপ্রিয় অ্যাপগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে যেমন নগদ, বিডিজবস, রেলওয়ে টিকিট, প্রথম আলো, নূর, কফি আড্ডা, ওয়াও বক্স, শিখো, ইভ্যালি,  বঙ্গ, পালস ইত্যাদি।

 

সফল অ্যাপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কথা

 

অ্যাপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এমসিসি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘আমরা অ্যাপ তৈরির কাজ শুরু করি প্রায় ২০০৯ সালে।  তখন তৈরি করতাম জাভা এবং সিমবিয়ান হ্যান্ডসেটের জন্য। ওই বছর থেকেই আমরা নকিয়া মোবাইলের জন্য অ্যাপ বানাতে শুরু করি। তখন নকিয়ার অভি স্টোরের জন্যই অ্যাপ বানাতাম। সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, শুধুমাত্র অ্যাপ তৈরির জন্য প্রশিক্ষণই দিলেই হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনার বিষয় হিসেবেও অ্যাপ অন্তর্ভুক্ত করে দিতে হবে।’

 

তিনি আরও জানান, বর্তমানে দেশে ৫০০-১ হাজার কোটি টাকার মত অ্যাপের বাজার রয়েছে। সরকারের প্রায় ৫০০ সেবা অ্যাপের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব। তিনি সরকারকে অ্যাপের মাধ্যমেই জনগণকে সেবা প্রদানের বিষয়টা আরও গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখার পরামর্শ দেন।

 

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৭-০৮ সাল থেকে এদেশে অ্যাপ তৈরি শুরু হয়েছে, যা আলোয় আসতে শুরু করে প্রায় ২০০৯ সাল থেকে। ২০১০ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী অ্যাপ লাগাতার জনপ্রিয় হতে শুরু করে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।

 

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘ফুড সার্ভিস, ট্রান্সপোর্টেশন, ডেলিভারি ইত্যাদি সেবার অ্যাপের চাহিদা অনেক গুণ বেশি। আমরা ভাবি গুগলে সবকিছু ফ্রি। কিন্তু কোনও ডেভেলপার যদি কাজের জন্য আলাদা তথ্য নিতে চায় তাহলে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়। অথচ সেই গুগল, ফেসবুকে আমরাই তথ্য দিই। একজন ডেভেলপারের সম্পদই হলো GIS (জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম)। ডেভেলপাররা সবসময় এগুলো নিয়ে কাজ করতে পারে। সিঙ্গাপুর, ভারত ও জাপানে গুগলের মতোই নিজস্ব ম্যাপিং সিস্টেম রয়েছে। সরকারও এই উদ্যোগ নিয়ে অন্যান্য দেশের মতো করে তৈরি করতে পারে ম্যাপভিত্তিক সেবার অ্যাপ।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *