কৃষি নীতি: খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার একটি নীলনকশা

দিনকাল বাংলাদেশ

ড. মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান

আঠারো শতকের বাংলা ছিল একটি সমৃদ্ধি ও সুখের দেশ। সেই স্বর্ণযুগের বাংলাদেশ ছিল কৃষি প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। দেশটি তখন কৃষি উৎপাদনের জন্য সারা বিশ্বে বিখ্যাত ছিল। মসলিন কাপড়, রেশম, তুলা, মশলা ইত্যাদি রপ্তানি করত বলে আমাদের এদেশ তখন অনেক বিদেশী ব্যবসায়ীকে আকর্ষণ করেছিল। অষ্টাদশ শতকে বাংলা ছিল তৎকালীন সময়ের একটি লোভনীয় বানিজ্য কেন্দ্র। সেসময়ের বাংলাকে জীবনমানের দিক থেকে গ্রেট ব্রিটেনের সাথে তুলনা করা হতো।

 

পরাধীনতার যাতাকলে বাংলার জৌলশ যখন অস্তমিত, সমৃদ্ধির দেশ যখন খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসেবে নিমজ্জিত, দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্রতা যখন জেঁকে বসেছিল বাংলায়, এ মাটিতে তখন আবির্ভাব হয় এক কালজয়ী নেতার- তিনি হলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। বাংলার গৌরবময় অতীতকে পুনরুদ্ধার করার চিন্তায় সর্বদা বিভোর থাকতেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন টেকসই কৃষি উৎপাদন অর্জনের মাধ্যমে বাংলার স্বর্ণযুগের গৌরবকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

 

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর অর্থনৈতিক সংকট ছিল প্রকট। সকল ধরনের মৌলিক চাহিদা বিশেষকরে খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রচুর। সারে সাত কোটি মানুষের দেশটিতে তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৫-৩০ লক্ষ মেট্রিক টন। স্বাধীন দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পরই বঙ্গবন্ধু কৃষিখাতে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল খাদ্যে বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। নয় মাসের যুদ্ধ বিধবস্ত দেশটিতে কৃষকরা মাঠে ফসল ফলাতে সমস্যায় পড়েন। যুদ্ধের সময় অনেক কৃষককে বাড়ি ছেড়ে যেতে হয়েছিল, ফলে অনেকেই জমি চাষ করতে পারেনি। এছাড়া ফসল ফলানোর জন্য কোন বীজ, সার ও কীটনাশক ছিল না। সেচ সুবিধার ঘাটতিও ছিল প্রকট। বঙ্গবন্ধু ভাল করেই জানতেন দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। তাই তিনি কৃষিক্ষেত্রের উন্নতির জন্য ১৯৭২ সালে সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন এবং বালার জনগণকে বেশি বেশি ফসল ফলানোর তাগিদ দেন।

 

বঙ্গবন্ধু ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকেই কৃষকদের জন্য একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। স্বাধীন দেশের প্রথম আর্থিক বাজেটে, মোট ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ১০১ কোটি টাকাই তিনি বরাদ্দ প্রদান করেন কৃষি খাতে। তাঁর সরকার স্লোগানটিকে কেবল স্লোগান হিসেবেই ব্যবহার করেনি; বরং ২২ লাখের বেশি গৃহহীন কৃষক পরিবারকে অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে দক্ষতার সহিত পুনর্বাসন করেছিল। তিনি দেশের ভূমিহীন কৃষকদেরকে খাস জমি বিতরণের ব্যবস্থাও করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য একটি কার্যকরী সমীক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা ছাড়া কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়ন সফল হবে না। যথাযথ পরিকল্পনার জন্য এটি অপরিহার্য ছিল। এ জরিপের ভিত্তিতে তিনি কৃষিক্ষেত্রের সার্বিক উন্নয়নের মহা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন।

 

শিক্ষিত জনগণকে কৃষিকাজে সম্পৃক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা ছিল প্রবল। বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ সম্মন্ধে যথেষ্ঠ জ্ঞান না থাকায় তিনি মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃষি শিক্ষা গ্রহণের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেলেন যাতে করে তারা বাংলার কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদের জন্য প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারে।

 

এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের সমাবর্তনে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি তাঁর বক্তৃতায় কৃষি গ্রাজ্যুয়েটদের উদ্দেশ্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন-”কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য শুধু বই পড়াই যথেষ্ঠ নয়। প্রত্যেক কৃষিবিদকে গ্রামে যেতে হবে এবং কৃষকদের সাথে থেকে কাজ করতে হবে এবং বাংলার কৃষকদেরকে কৃষি বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।

 

১৯৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছরে বাংলাদেশের খাদ্য ঘাটতি কোন সরকারই মেটাতে সক্ষম হয়নি। এবপর বাংলার ভাগ্যাকাশে আবারও একটি গৌরবময় অধ্যায় লিখিত হয় ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে, যখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পরপরই পিতার অংকিত পরিকল্পনাকে হৃদয়ে ধারণ করে তাঁরই দেখানো পথ ধরে বাংলাদেশের কৃষি বিপ্লবের পূণর্জাগরণ করেন। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।

 

সেই প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনার সরকার বিদ্যুৎ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গৌরবময় সাফল্য অর্জন করেছিল। মাত্র পাঁচ বছরে মোট বিদ্যুত উৎপাদন ১৯৯৫ সালের বেগম খালেদা জিয়া সরকারের ২,৯০৮ মেগাওয়াট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০১ সালে শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে ৪,৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছিল, যা সরাসরি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। ১৯৯৬-২০০১ সালে অওয়মী লীগ সরকারের আমলে দেশটি অভূতপূর্ব কৃষি প্রবৃদ্ধি দেখেছিল। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি শাসনামলে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকেনি। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার জনগনের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয় এবং সার, বীজ, ডিজেল প্রভৃতি কৃষি উপকরণ সংগ্রহ ও বিতরণে মারাত্মক অব্যবস্থাপনা করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে আসে। এসব নেতিবাচক কর্মকা-ের কারণে খাদ্যে স্বনির্ভর একটি দেশ আবারও খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত হয়।

 

এ অবস্থায় শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি খাদ্যের মূল্য গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং ২০১২ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার অঙ্গীকার নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ২০০৭-০৮ এর খাদ্য সংকটের ধাক্কা এবং ২০০৯ সালের ঘুর্ণিঝড় আইলার আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতিকে কাটিয়ে উঠে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে শেখ হাসিনার সরকার নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করে। তাঁর সরকার সার, মানসম্মত বীজ, ডিজেলসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের উপর ভর্তুকি বৃদ্ধি করাসহ সহজ শর্তে কৃষকদের মাঝে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করে। এভাবে, ২০০৯ সালের শেষ নাগাদ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ৩.৫% থেকে ৪.৫% এ ফিরে আসে।

 

২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার ক্রমাগত সরকার কৃষি খাতে একটি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে যা একটি উল্লেখযোগ্য স্তরে দারিদ্র বিমোচন করেছে এবং বাংলাদেশ থেকে মঙ্গা দূরীভূত হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার দেশের ১০০% জনসংখ্যাকে বিদ্যুতের আওতায় নিয়ে এসেছে। যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থাপনার অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। যার ফলে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৩২.৯০ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭.৭৭ টনে পেীঁছেছে।

 

শেখ হাসিনা সরকারের কৃষি বান্ধব নীতির ফলস্বরূপ বাংলাদেশ এখন পাট রপ্তানিতে প্রথম, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, হেক্টর প্রতি ফলের ফলন বৃদ্ধিতে প্রথম, শস্যের জাত উন্নয়নে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাল ও চা উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা ও আলু উৎপাদনে চতুর্থ এবং স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ। ২০২১ সালের তথ্যসম্বলিত ঋঅঙ কর্তৃক প্রকাশিত ২০২৩ সালের মার্চ মাসের রিপোর্ট ইঙ্গিত করে যে, ভূমির আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ ৯৪তম হলেও প্রাথমিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ১৪তম স্থানে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে চাল, মসুর, আলু, পেঁয়াজ, চা এবং বিভিন্ন ফলসহ ২২ টি কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে ১০ টি শীর্ষ দেশের মধ্যে রয়েছে। বর্তমান সরকারের কার্যকর কর্মসূচির ফলে বাংলাদেশের ৪০০০ বিলিয়ন টাকা মূল্যের ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন উল্লেখযোগ্য কৃষি উৎপাদন বৈশ্বিক কৃষি বাজারে দেশের কৃষি দক্ষতা ও গুরুত্বকে তুলে ধরে।

লেখক: চেয়ারম্যান, সার্জারি ও থেরিওজেনোলজি বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *